মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের দুই মাস পরও বন্ধ হচ্ছে না রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আগমন। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের প্রায় ৩০ হাজার নতুন রোহিঙ্গা আসার মাথায় বৃহস্পতিবার (০২ নভেম্বর) আবারও সীমান্ত অতিক্রম করছে প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা।
Advertisement
বুধবার রাত ও বৃহস্পতিবার ভোরে উখিয়ার পালংখালীর আঞ্জুমানপাড়া এবং টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ সীমান্ত দিয়ে এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে।
স্থল সীমান্ত আনজুমানপাড়া দিয়ে প্রবেশ করা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার রোহিঙ্গাকে শূন্যরেখায় আটকে দিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তবে সেখানে ৩ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্ট সীমান্তে দায়িত্বরত কক্সবাজার ৩৪-বিজিবি উপ-অধিনায়ক ইকবাল আহমদ।
কিন্তু শূন্যরেখায় অবস্থানরত মংডু বুচিদং এলাকার আলী আকবর (৫৪) ও আফজল হোসেনসহ (৩৬) অন্যদের দাবি, আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তের ওপারে আরও প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পথে রয়েছে। শীতের তীব্রতা ও খাদ্যভাবে তারা বাংলাদেশমুখী হচ্ছে বলেও দাবি করেন তারা।
Advertisement
আবার শাহপরীরদ্বীপ দিয়ে ভোর থেকে সারাদিনে প্রায় ৫ শতাধিক রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও পুরুষ জলসীমা পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। ১৬ অক্টোবরের পর ২ নভেম্বর আবারও রোহিঙ্গা স্রোতের খবরে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
এর আগে ১৬ অক্টোবর আসা প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা নারী-শিশু-পুরুষকে চারদিন পর ১৯ অক্টোবর কুতুপালং-বালুখালী ক্যাম্প এলাকায় নিয়ে আসা হয়। এতে করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার অবস্থান কেবল বাড়ছে। বৃহস্পতিবার আসা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত আসছে তার দিকেই তাকিয়ে আছে সীমান্ত সংশ্লিষ্টরা।
রোহিঙ্গা আসার সত্যতা নিশ্চিত করে বিজিবির কক্সবাজার ৩৪-ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মনজুরুল হাসান বলেন, আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে নতুন করে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে সীমান্তের নাফনদীর পাড়ে জড়ো করে রাখা হয়েছে। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত তারা উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে এখানে এসে জড়ো হয়।
তিনি আরও জানান, নতুন আসা এসব রোহিঙ্গার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন মহলকে অবহিত করা হয়েছে। নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
Advertisement
এদিকে, পালংখালী ইউপির চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, ৫-৬ হাজার রোহিঙ্গাকে আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তে বসিয়ে রেখেছে বিজিবি। জড়ো করে রাখা এসব রোহিঙ্গাদের শুকনা খাবার ও স্বাস্থ্যগত সহায়তা দিচ্ছে এনজিও সংস্থার লোকজন।
গত কয়েকদিন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু রোহিঙ্গা পরিবার সীমান্ত প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। তারা বাংলাদেশে অবস্থানরত স্বজনদের সহযোগিতায় কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পে চলে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
গত ৩০ ও ৩১ অক্টোবর পুরো কক্সবাজারজুড়ে ভারী বর্ষণ হয়। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর প্রকৃতিতে এখন তীব্র শীতের আমেজ শুরু হয়েছে। এতে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা চরম বিপর্যয়ে পড়ছে। শিশুদের নিউমোনিয়া ও বৃদ্ধদের শ্বাসকষ্ট বাড়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন রয়েছে শূন্যরেখায় ও ক্যাম্পে অবস্থানরত আশ্রিতরা।
পালংখালী ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান ও বালুখালী ওয়ার্ডের মেম্বার (সদস্য) নুরুল আবছার চৌধুরী জানান, পুরনো এবং চলমান আরাকান সঙ্কট মিলিয়ে প্রায় ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছে। এ সংখ্যা সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ-উখিয়ার স্থানীয় জনগণের চেয়ে অধিক। এখানে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের খাবার, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশনসহ প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছি আমরা।
রোহিঙ্গাদের কারণে পাহাড়গুলো দখল হয়ে গেছে। সাবাড় হচ্ছে গাছপালা। অভয়ারণ্য হারাচ্ছে বন্যপ্রাণি। ফলে হাতিরপালের আক্রমণে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এসব মৃত্যু সরকারের জন্য বিব্রতকর। এটা ছাড়াও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক এবং নিষিদ্ধ বস্তু আসছে। ইতোমধ্যে আইনপ্রয়েগকারী সংস্থার হাতে অনেক রোহিঙ্গা অস্ত্র, বোমা ও ইয়াবাসহ আটক হয়েছে। মানবিকতার সুযোগে তারা আমাদের সামাজিক পরিবেশ বিষিয়ে তুলছে।
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং ক্যাম্পে প্রতিষেধক ক্যাম্পেইন ইনচার্জ ডা. মিছবাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানকরা রোহিঙ্গাদের কলেরাসহ কয়েকটি টিকার আওতায় এনেছি। নতুন করে সীমান্ত পার হওয়াদের কোনো টিকার আওতায় নেয়া হয়নি। তবে তাদেরকে ক্যাম্পে আনা হলে ৪ নভেম্বর শুরু হওয়া কলেরার দ্বিতীয় রাউন্ডে টিকার আওতায় নিয়ে আসা হবে।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য মতে, গত ২৫ আগস্ট থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে নতুন রোহিঙ্গা আগমন হয়েছে ৬ লাখ ৭ হাজার। কিন্তু স্থানীয় দায়িত্বশীলদের মতে, এ সংখ্যা ৮ লাখ ছাড়িয়েছে। পূর্বে বাংলাদেশে আরও প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গার অবস্থান রয়েছে।
এএম/জেআইএম