ভোরের আলো ফুটলেও কোলাহল ফেরেনি তখনো। দুই-একটি রিকশার টুংটাং বেলের আওয়াজ মাত্র। মুসল্লিরা ফজরের নামাজ শেষে গলি পথে হাঁটছিলেন। হঠাৎই একটি বাড়ির ছাদ থেকে নারীর কান্নার আওয়াজ। ছুটে যান মুসল্লিরা। তবে তখনো বাড়িটির প্রধান ফটক তালাবদ্ধ। মুসল্লিদের হাঁকডাকে ঘুম ভাঙে বাড়ির মালিকের স্ত্রী নাসিমা দুলালের। বাড়ির ছাদে গিয়ে তিনি দেখেন ভাড়াটিয়া জামিল ও তার মেয়ে নুসরাতের নিথর দেহ। পাশে আহাজারি করছেন স্ত্রী আরজিনা বেগম।
Advertisement
নাসিমা দুলালের জেরার মুখে ঘটনা সম্পর্কে আরজিনা বলেন, ‘আপা ডাকাত পড়ছিল। চারজন মুখোশধারী আমার হাত-পা ও মুখ বেঁধে স্বামী জামিলকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে খুন করেছে। শ্বাসরোধ করে মারছে মেয়ে নুসরাতকে।’
এরপর মানুষের ভিড় জমে। পরিচিত মানুষের একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়ে নিহতের স্ত্রী আরজিনা। শুরু হয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। খবর পেয়ে পুলিশ আসে। মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে।
বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার দিকে রাজধানীর উত্তর বাড্ডার ময়নারবাগের ৩০৬-পাঠানভিলার তৃতীয় তলার ছাদের চিলেকোঠায থেকে উদ্ধার করা হয় বাবা জামিল (৩৮) ও মেয়ের নুসরাতের মরদেহ।
Advertisement
বাড্ডা থানা পুলিশ জানায়, জামিলের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরের করপাড়া ইউনিয়নের বনপাড়া গ্রামে। নিহত জামিলের বাবার নাম বেলায়েত শেখ (মৃত)। সম্প্রতি তেজগাঁওয়ের বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে তিনি গাড়িচালক হিসেবে যোগদান করেন।
বুহস্পতিবার বেলা ১১টায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাঠান ভিলায় ছোট ছোট সব ফ্ল্যাট। তৃতীয় তলায় দুটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকতেন গাড়িচালক জামিল। গত কোরবানির ঈদের পর স্ত্রী আরজিনা (৩০) মেয়ে নুসরাত (৭) ও ছেলে আলফিকে (৩) নিয়ে ওই বাসায় ওঠেন জামিল।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই বাসার নিচ তলার ভাড়াটিয়া জোসনা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘কান্নাকাটির আওয়াজ ও বাইরে মুসল্লিদের হাঁকডাকে বাসার মালিকের বউ আমাকে উপরে পাঠান। গিয়ে দেখি কান্নাকাটি করছে আরজিনা। ভেতরে পুরুষটা রক্তাক্ত। মাথা থেকে রক্ত বেয়ে মেঝে ভিজে গেছে। মাইয়াডার কোনা সাড়া-শব্দ নাই। আমি চিক্কার (চিৎকার) দিয়া নিচে নামি। আপারে (মালিকের স্ত্রী) বলি, আপা আপনি গিয়া দেখেন সর্বনাশি ঘটনা।’
‘এরপর আপায় উপর যান, দেখে পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ আসে। পুলিশ ওই মহিলারে নিয়ে থানায় চইল্লা গেছে’-বলেন জোসনা বেগম।
Advertisement
বাসার মালিক দুলাল পাঠানের স্ত্রী নাসিমা দুলাল বলেন, আরজিনা বলছিল, ‘ডাকাত পড়েছিল, চারজন মুখোশধারী নাকি ঘরে ঢুকে অস্ত্রের মুখে আরজিনারে জিম্মি করে। হেরপর জামিল ও মাইয়াডারে খুন কইরা চইল্লা গেছে।’
তিনি বলেন, ‘তার (আরজিনা) কথা আমার বিশ্বাস হয় নাই। কারণ আমার বাসার গেট তালাবদ্ধ ছিল। বাইরে থেকে আসা সম্ভব না। আর দেয়াল টপকে উপরে উঠলে মানুষ টের পাইত। এখানে অন্য কোনো কেইস আছে। আগে থেকে কেউ আইসা অবস্থান নিছিল কি-না!’
অন্য কী কারণ বা কারা খুন করতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এইডা পুলিশ বুঝব, তবে মহিলার মতিগতি ও কথাবার্তা খুব সুবিধার না। এখানে ডাকাত আইব কোত্থেকে?’
পাশের অন্য ভবনের নিচ তলার বাসিন্দা পিংকি বেগম বলেন, উপরে রাতে শব্দ হলেই কানে আসে। গত রাতে খুন হইলে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পায়তাম। বাইরে থাইকা কেউ আইলেও বোঝা যাইত। আমি ৪টার পর থাইক্কা জাগনা (জেগে)।
পিংকি বলেন, ‘আরজিনা যে দাবি তুলছে, তার ভিত্তি পাইতেছি না। আগে থেকে কেউ এসে ভবনে থেকে খুন করে পালাইছে, নাকি হেই নিজে খুন করছে তা বলা মুশকিল।’
নিহত জামিলের ভাগ্নে রুবেল জাগো নিউজকে বলেন, আমি, জামিল ও শামীম মামা একলগে একই অফিসে চাকরি করি। গত সপ্তাহে জামিল মামা আমারে বলছিল, ‘মামা তোমার মামি যা-তা শুরু করছে। না পারছি বলতে না পারছি সইতে’। কিন্তু তিনি পরিষ্কার কিছু বলেন নাই। আমি আর আগ্রহ দেখাই নাই, পারিবারিক সমস্যা কম বেশি সবারই থাকে। কিন্তু মামা খুনের পর সে কথাগুলো বারবার মনে পড়তেছে।
বাড্ডা থানার সামনে নিহত জামিলের বড় ভাই ইব্রাহিম ইবু বলছিলেন, ১২ বছরের সংসার ওদের। গত চার বছর ধরে প্রায়ই শুনি ওদের (স্বামী স্ত্রী) মধ্যে ঝামেলা। এভাবেই চলছিল। মাস তিনেক আগে ঝগড়া করে ওর বউ আরজিনা গ্রামের বাড়ি চলে যায়। তবে ফের কোরবানির ঈদের পর ঢাকায় আসে। এ বাসায় এসে গত সপ্তাহেও ওদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়েছে শুনেছি।
‘ওর স্ত্রী পরকীয়া করে এমন অভিযোগ করেছিল জামিল। কিন্তু পাত্তা দিইনি। এখন মনে হচ্ছে, একসঙ্গে রাতে থেকে স্বামী ও মেয়ে মারা যায় আর স্ত্রী জীবিত থাকে কীভাবে?’ ভাই হত্যার পেছনে ভাইয়ের স্ত্রীর কোনো যোগসাজশ রয়েছে বলে দাবি ইব্রাহিমের।
বাড্ডা থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী জাগো নিউজকে জানান, মরদেহ দুটি উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বাবাকে পিটিয়ে ও মেয়েকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার কারণ এখনও স্পষ্ট নয়, তবে প্রাথমিকভাবে পরকীয়া ও আর্থিক কারণ গুরুত্ব দিয়ে ঘটনার তদন্ত চলছে। থানা হেফাজতে নিয়ে ঘটনা সম্পর্কে নিহতের স্ত্রী আরজিনা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
জেইউ/জেডএ/জেআইএম