আখ অর্থকরী ফসলের মধ্যে অন্যতম। আখ থেকে চিনি, গুড় এবং রস পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মোট আবাদকৃত জমির ২.০৫% আখের আবাদ হয় যার পরিমাণ ১.৭০ লাখ হেক্টর। মিলজোনে ০.৮৬ লাখ হেক্টর এবং ননমিলজোনে ০.৮৪ লাখ হেক্টর। আসুন আখ চাষের পদ্ধতি জেনে নেই-
Advertisement
সাথীফসল নির্বাচনে বিবেচ্য
সাথীফসলটি যদি আখের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, তাহলে সাথীফসল এবং আখের ফলন কমে যেতে পারে। তাই সাথীফসল নির্বাচনে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব দিতে হবে। তা হচ্ছে- অবশ্যই ছোট আকৃতির ও খাড়া জাতের হতে হবে। মেয়াদ অবশ্যই চৈত্র-বৈশাখ মাসে শেষ হতে হবে। শিকড়ের গঠন এমন হবে যেন আখের নালায় ছড়িয়ে না পড়ে। ফলন, প্রতিক্রিয়া এবং উভয় ফসলের আয়-ব্যয় বিবেচনায় আনতে হবে। উৎপাদিত সাথীফসলের বাজারজাত ও গুদামজাত করণের সুবিধা থাকতে হবে।
আবাদের নিয়ম
Advertisement
সাফলভাবে সাথীফসল করতে হলে আখের সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩.০-৩.৫০ ফুট হতে হবে এবং সারি করে বপণ বা রোপণ করতে হবে। জোড়াসারি পদ্ধতিতে সাথীফসল করতে হবে। প্রত্যেক ফসলের জন্য অনুমোদিত হারে সার ও কীটনাশক পৃথকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। প্রত্যেক ফসলের পরিচর্যা সঠিক সময়ে করতে হবে এবং সাথীফসল তোলার পর ফসলের অবশিষ্ট অংশ সরিয়ে ফেলতে হবে অথবা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সাথীফসলের রোগবালাই ও পোকামাকড়ের সমন্বিত দমন ব্যবস্থা নিতে হবে।
উপযোগী সাথীফসল
আলু, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, লালশাক, পালনশাক, পেঁয়াজ, রসুন, মশুর, সরিষা ও অন্যান্য শীতকালীন সবজি।
আরও পড়ুন- ৩ মৌসুমেই কলা চাষ করতে পারেন
Advertisement
জোড়াসারিতে রোপণ
ভালোভাবে তৈরি করা জমিতে ১.৫-২.০ ফুট দূরত্বে হাত লাঙল বা কোদাল দিয়ে লাইন টেনে ৬-৯ ইঞ্চি গভীর নালা করে মাটি ১.৫-২.০ ফুট দূরত্বে দু’নালার মধ্যবর্তী স্থানে রাখতে হবে। এরপর ৪-৪.৫ ফুট ফাঁকা রেখে একইভাবে আবার দুটো জোড়াসারির নালা করতে হবে। এভাবে নালার মাথায় মাথায় তিন চোখ বিশিষ্ট বীজখণ্ড স্থাপন করে অথবা ১.৫-২.০ ফুট দূরত্বে ব্যাগ বা বেডচারা রোপণ করতে হবে। এ পদ্ধতিতে জমিতে আখের মোট সারির সংখ্যা প্রচলিত পদ্ধতির সমানই থাকে। শুধু আখের সারির ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করে সাথীফসল চাষাধীন জমি বাড়ানো যায়। ফলে আখের ফলনে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় না।
সারির সংখ্যা
সাথীফসলের সাথে সারির যে রকম সংখ্যা হতে পারে। তা হচ্ছে- আলু আগাম জাত-৩, আলু নাবী জাত-২, সরিষা ২-৩, ছোলা-২, পেঁয়াজ/রসুন ৫-৬, মসুর- ৩, কপি-২ সারি।
দ্বিতীয় চাষ
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রথম সাথীফসল সংগ্রহ করে আরও একটি দ্রুত বর্ধনশীল ও স্বল্পমেয়াদী সাথীফসল চাষ করা যায়। সম্পূরক সেচ, মাটির রস, মৌসুমী বৃষ্টিপাত, প্রথম সাথীফসলের ধরন ও জমির উর্বরতার ওপর দ্বিতীয় সাথীফসল চাষ ও এর ধরন নির্ভর করে। দ্বিতীয় সাথীফসল হিসেবে যে ফসলগুলো চাষ করা যায়, তা হলো-ডাঁটা, পুঁইশাক, মুগ, চিনাবাদাম, কলমিশাক, ঢেঁড়শ, ধৈঞ্চা ও নীল (সবুজসার)। বিশেষ করে প্রথম সাথীফসল হিসেবে আলু ও দ্বিতীয় সাথীফসল হিসেবে ডাঁটা, কলমিশাক ও মুগ ইতোমধ্যেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
মুড়ি আখের সঙ্গে
আখ কাটার পরপরই শুকনো পাতা পুড়িয়ে আখের গোছা মাটি সমান করে কেটে জমি পরিষ্কার করে দু’সারি আখের মধ্যবর্তী স্থান গভীর করে লাঙল বা পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষ দিতে হবে। আখের গোছার দু’পাশে অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে গোছার দু’পাশের মাটি আলগা ও সার মেশানোর কাজ করে সব জমি মই দিয়ে সমান করে নিতে হবে। এমন দু’সারি আখের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় সময় ও জমি উপযোগী সাথীফসল বপন বা রোপণ করতে হবে। সাথীফসলের জন্য অনুমোদিত মাত্রায় সার অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে।
সময়ভেদে চাষ
অক্টোবরে কর্তণকৃত আখের জমি: এসব জমিতে পেঁয়াজ, ক্রান্তি জাতের মুগডাল, আগাম আলু, মাসকলাই, পালংশাক, আগাম ফুলকপি, টমেটো, বাঁধাকপি, মুলা ইত্যাদি সাফলভাবে চাষ করা যায়।
নভেম্বরে কর্তণকৃত আখের জমি : যেকোন ধরনের উপযোগী সাথীফসল মুড়ি আখের সাথে ফলানো সম্ভব। বিশেষভাবে উপযোগী কয়েকটি সাথীফসল হলো- আলু, মিষ্টি আলু, সরিষা, মসুর, রসুন, ছোলা, গম এবং বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি।
ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে কর্তণকৃত আখের জমি : এসময় কর্তণকৃত আখের মুড়ি না রাখাই ভালো। তবে উপায় না থাকলে ব্যাগচারা দিয়ে গ্যাপ পূরণ করে মুড়ি রাখা যেতে পারে। সাথীফসল হিসেবে পেঁয়াজ, নাবীজাতের বিলেতি শাকসবজি এবং আগাম তরমুজ চাষ করা যেতে পারে।
ফেব্রুয়ারি মাসে কর্তণকৃত আখের জমি : এসময় আখের জমিতে প্রয়োজনীয় রস থাকলে বা সেচের সুবিধা থাকলে বামুন জাতের চিনাবাদাম (ডিজি-১), মুগডাল, তরমুজ, গিমাকলমি, ডাঁটা, পুঁইশাক ইত্যাদি অনায়াসে চাষ করা যায়।
সাথীফসল তোলার পর আখের সারির মধ্যবর্তী স্থান ভালোভাবে কুপিয়ে ফসলের অবশিষ্টাংশ মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে এবং একরপ্রতি ৩৭ কেজি ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে। তবে জমিতে রস না থাকলে সেচ দিয়ে হলেও সার ব্যবহার করতে হবে। পদ্ধতিগতভাবে বা সুপারিশমতো চাষ করলে সাথীফসল ছাড়াও আখের উচ্চ ফলন পাওয়া যাবে।
অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
বীজ রোপণ বা চারা রোপণ এবং ফসল কাটার মধ্যবর্তী সময়ে আখের জমিতে যে সব কাজ করা হয়, তার সবগুলোই অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা। বীজ অঙ্কুরোদগম হয়নি বা রোপিত চারা নষ্ট হয়ে গেছে, এরূপ ফাঁকা জায়গা পূরণ, মাটি আলগা করা, আগাছা পরিষ্কারকরণ, সারের উপরি প্রয়োগ, চারার গোড়ায় মাটি দেওয়া, আখ বাঁধা ইত্যাদি অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা।
শূন্যস্থান পূরণ
আখ রোপণের পর কখনো কখনো সন্তোষজনক অঙ্কুরোদগম হয় না। জমিতে যে স্থানে বীজ গজায়নি তা নিশ্চিত হয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই ফাঁকা স্থানে বীজ রোপণ করা প্রয়োজন। দু’ফুট দূরত্বের মধ্যে কোন চারা দেখা না গেলে সেখানে বীজ গজায়নি বলে ধরে নিতে হবে এবং অবিলম্বে সেখানে সুস্থ-সবল বীজ রোপণ করতে হবে। চারা যে পদ্ধতিতে রোপণ করা হয়েছিল; সে পদ্ধতিতে ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে হবে এবং তা অবশ্যই একই জাতের আখবীজ দিয়ে করতে হবে।
আরও পড়ুন- পেঁপে উৎপাদন করবেন যেভাবে
মাটি আলগাকরণ
চারা অবস্থায় ভারি বৃষ্টিপাতের পর জমিতে জো এলে অবশ্যই মাটি আলগা করে দিতে হবে। বীজ রোপণের পরে এবং অঙ্কুরোদগম শেষ হওয়ার আগে বৃষ্টিপাত হলে জমির উপরিভাগ শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। শক্ত স্তরের জন্য বীজের চোখ গজাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ অবস্থায় অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে ছোট কোদাল দিয়ে জমির উপরিভাগ হালকাভাবে কুপিয়ে দেওয়া উচিত, যাতে নতুন চারাগুলো মাটি থেকে উঠে আসতে পারে। এসময় সতর্কতা নিতে হবে যেন চারা কেটে না যায়। আখের বৃদ্ধিকালীন সময়ে যতবারই ভারি বৃষ্টিপাত হবে, জো আসার সঙ্গে সঙ্গে ততবারই মাটি আলগা করে দিতে হবে। চারা অবস্থায় মাটি আলগাকরণের সময় খেয়াল রাখতে হবে, যেন মাটি চারার গোড়ায় পড়ে নালা ভর্তি না হয়। চারার গোড়া মাটি চাপা পড়লে কুশি কম হবে এবং কুশির বৃদ্ধি ব্যাহত হবে।
আগাছা দমন
আগাছা দমন ব্যবস্থা না করলে ফসলের ফলন কমে যায়। কারণ আগাছা পানি ও খাদ্যের জন্য ফসলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। ফসলের তুলনায় আগাছার বৃদ্ধি দ্রুত হয়ে থাকে। তাছাড়া ঘন আগাছা নানা ধরনের পোকামাকড়ের ডিম পাড়ার আকর্ষণীয় স্থান। অনেক মাজরা পোকা ঘাসের জন্য আখের ক্ষেতে আকৃষ্ট হয়।আগাছার বৃদ্ধি, জমির অবস্থা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করেই আগাছা দমনের উপযুক্ত সময় বেছে নেওয়া ভালো। আগাছা গজানোর পরপরই নিড়ানি দিয়ে সহজেই নির্মূল করা যায়। এসময় উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আখের তেমন ক্ষতি হয় না। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এরা বেশি পরিমাণ রস ও খাদ্য মাটি থেকে সংগ্রহ করতে থাকে। এ পর্যায়ে আগাছা দমন ব্যবস্থা কষ্টসাধ্য। ফুল ধরার আগে আগাছা দমন ব্যবস্থা না করলে এদের বংশ বিস্তার ঘটবে এবং পরবর্তী বছরে এদের প্রকোপ ব্যাপকতর হবে।
এসইউ/জেআইএম