ভ্রমণ

ব্যয়বহুল নগরী লন্ডনের অভিজ্ঞতা

ব্রিটিশ মিউজিয়ামের দেয়ালে সে দেশের প্রখ্যাত লেখকের একটি উক্তি স্তব্ধ করে দিয়েছিল আমাকে। স্যামুয়েল জনসনের সেই লেখাটি ছিল- ‘When a man is tired of London, he is tired of life; for there is in London all that life can afford.’ তাৎক্ষণিকভাবে বাক্যটির শাব্দিক অর্থ বুঝলেও পারিভাষিক অর্থ বুঝতে আমার প্রায় চার বছর তিন মাস লেগে গিয়েছিল।

Advertisement

২০০৯ সালের শেষের দিকে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্যে যাওয়ার ফলে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে আমার ঢের অভিজ্ঞতা হয়েছে। লন্ডনের অলি-গলিতে হাঁটতাম আর মাকড়শা জালের বিস্তৃত অথচ গোছানো শহরকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করতাম। কখনও নিশ্চুপ সৌখিন মানুষদের শহর, জাদু্ঘরের শহর, প্রদর্শনীর শহর, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শহর, কখনও বা স্থাপত্য কলার শহর, আরও কত কী?

শীতকাল, ক্রিসমাসের সময়। প্রথমদিকে মনে হতো এ কোনো ভৌতিক শহরে আসলাম। জিরো বা তার কম ডিগ্রির ঠাণ্ডা, তুষারপাত কিংবা পাতাল রেল- এসবই আমার কাছে নতুন। সময় গড়ায় আর আস্তে আস্তে খুলতে থাকে এসব জট। খুঁজে পেতে থাকি ভৌতিকতার ভেতরে আলোর ঝলকানি।

গ্রীষ্মকাল আসতেই বেড়িয়েছি অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজের মতো নামকরা প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় সহস্র বছরের পুরনো ক্যাম্পাসগুলো আমাকে তাদের অদৃশ্য সুতো দিয়ে বার বার কাছে টেনে নিয়েছে। দেখেছি রোমান কর্তৃক কার্ডিফ শহরের নির্মিত দুর্গ। ড্যান্ডির সন্নিকটে স্কট রাজা রবার্ট ব্রুস প্রায় হাজার বছর আগের (১২৭৪-১৩২৯) করা প্রাচীর, যা এখনও প্রায় অক্ষত। সুযোগ হয়েছে বাথে (Bath) ব্রিটেনের প্রথম রাজার মুকুট দান (৭৫৭) দরবার দেখার।

Advertisement

আরও পড়ুন- বিলুপ্তপ্রায় গাছ দেখবেন যে বাগানে

আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চলের তিনটি বৃহৎ নগরীর মধ্যে লন্ডন অন্যতম, বাকি দুটি প্যারিস এবং নিউইয়র্ক। লন্ডন শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে টেমস নদী। এ নদীর দু’পার দিয়ে নির্মিত হয়েছে স্থাপত্য ও বিনোদন কেন্দ্র। ব্রিটেনের প্রথম রাজদরবার ছিল এ টেমস নদীর পার ঘেঁষে যদিও তা এখন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বার্কিংহাম প্যালেসে। অবকাশ যাপনের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নগরীর তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে এ লন্ডন। দৈনিক অবকাশ যাপনের জন্য পর্যটকরা গড়ে প্রায় ৩৫ হাজার টাকার ওপরে ব্যয় করে থাকেন। সংস্কৃতি, শিক্ষা, ফ্যাশন, শিল্পকলা, গবেষণা, গণমাধ্যম, অর্থ-ব্যবস্থা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু এ নগরী।

এ শহরে না গেলে আধুনিক কালের যে কোনো পর্যটকের ভ্রমণ পিপাসা নিবারণ হবে না। লন্ডন সপ্তদশ শতক থেকেই ইউরোপে তার প্রথম স্থান বজায় রেখে আসছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এটিই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। কারণ তখন বিশ্বের উল্লেখযোগ্য অনেক স্থানই ছিল ব্রিটিশ রাজত্বের অধীন আর লন্ডন ছিল সেই রাজত্বের রাজকীয় ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র। বর্তমান যুগেও লন্ডন পৃথিবীর অন্যতম প্রধান অর্থ-বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। আর এ টেমস নদীকে ঘিরেই প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে বাণিজ্য ও সাম্রাজ্য পরিচালনা। টেমসের ‘নদী শাসন’ ব্যবস্থাও অবাক করার মতো।

লন্ডনের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে ত্রাফালগার স্কয়ার, টাওয়ার ব্রিজ, লন্ডন ব্রিজ, কভেন্ট গার্ডেন, লন্ডন চিড়িয়াখানা, প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর, বিজ্ঞান জাদুঘর, গ্লোব থিয়েটার, চার্লস ডিকেন্স জাদুঘর, মাদাম তুসো, বিগ বেনসহ কত কী। প্রতিবছর প্রায় ১৪ মিলিয়ন পর্যটক লন্ডনে আসে এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে। যুক্তরাজ্যের অন্যান্য শহরে রয়েছে নানা ধরনের ঐতিহ্য ও স্থাপত্য। ‘লো-রাইজ’ শহর বলে লন্ডনের একটি সুখ্যাতি আছে যা তারা বজায় রাখতে সদা সচেতন। হাই রাইজ বা উঁচু-অট্টালিকা বলতে সেখানে আছে হাতেগোনা কয়েকটি।

Advertisement

মিশ্র সংস্কৃতির এক স্বপ্নীল দেশ ব্রিটেন। কত ভাষার, কত বর্ণের মানুষের সঙ্গে যে মেশার সুযোগ হয়েছে- তা এক বিরল অভিজ্ঞতা। যার যার তার তার করে নদীর স্রোতের মতো বয়ে চলা। দেখেছি লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে চায়না টাউনে চাইনিজ নববর্ষ উদযাপন। পূর্ব লন্ডনের বেথনালগ্রিনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে মেলায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। দু’বার গিয়েছিলাম ব্রিটেনের জাতীয় বোটানিক্যাল গার্ডেন ‘কিউ গার্ডেনে’। দেখার মতো কারণ হাজার রকমের ফুল ও ক্যাকটাসের সমারোহ।

ব্রিটেনের প্রাচীন সব স্থাপত্য নিদর্শন এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা ব্রিটিশ রাজপরিবারের কড়া নির্দেশ। বেমালুম নিরুপায় না হলে যেটা যেভাবে আছে; সেটা সেভাবেই থাকবে। রাজপরিবার, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। রয়েছে ‘হেরিটেজ লটারি ফান্ড’র মতো ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য আর্থিক যোগানের ব্যবস্থা। ব্রিটিশ বন্ধুদের মুখে একটি কথা প্রায় শুনতাম, আর তা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। তারা কোনো প্রকল্প এক বছরের জন্য করলে, তার পরিকল্পনা করে দুই বছর ধরে আর ভবিষ্যৎ ভাবে ২০ বছরের।

প্রথমদিকে পূর্ব লন্ডনের যে বাড়িতে আমি থাকতাম, ভয় হতো। কারণ কবে না আবার ভেঙে পড়ে। কারণ বাড়িটি ছিল ১৮৩৯ সালের নির্মাণ। বন্ধুরা সাহস জুগিয়েছে, ভয় নাই, প্রতিবছর কাউন্সিল থেকে এগুলোর ফিটনেস চেক করা হয়। এ এক গোছানো ও সমন্বিত প্রয়াস। আমার কাছে মনে হয়েছে, টেকসই পরিকল্পনা ও সংরক্ষণ কৌশলই এগুলো অটুট রাখার মূলমন্ত্র।

এগুলো বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, সেদিনের নির্মাণ। অথচ এর বয়স প্রায় শত বছর বা তারও বেশি। এগুলোকে অক্ষত রাখার পেছনে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্য করে আসছে। তারা পুরো মাত্রায় মেনে চলছেন নিয়মাবলী।

আরও পড়ুন- দুই মাস খোলা থাকে যে বাগান

এত গেল পুরনো সব কাহিনি। নতুনের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে লন্ডন আই। যাতে উঠলে গোটা লন্ডনটা একঝলক দেখে নেওয়া যায়। রয়েছে অনেক প্রকার এম্যাসেজমেন্ট পার্ক। পাতাল রেল দিয়ে গন্তব্যে যাওয়ার মারপ্যাচ বুঝতে বেশ কিছুদিন পার হয়ে গিয়েছিল। অনুন্ধানে দেখা যায়, আমরা যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে তখনই তারা পাতাল রেলের উদ্ভাবন করে অর্থাৎ ১৮৬৩ সালে। কত প্রকারের জাদুঘর যে রয়েছে তার হিসাব মেলা ভার। রয়েছে ভিক্টোরিয়া ও আলবার্ট মিউজিয়াম, লন্ডন মিউজিয়াম, চাইল্ড মিউজিয়াম, ফ্যান মিউজিয়াম, ট্রান্সপোর্ট মিউজিয়াম- আরও কত কী।

শতবর্ষ পুরনো কার্ডিফ মেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করে ২০১৪ সালের এপ্রিলে দেশে ফিরে আসা নিজেই কিছু করবো বলে। তবে এতকিছু দেখার পরও দেশে ফেরার সময় মনে হচ্ছিল, তেমন কিছুই তো দেখা হলো না। মনে পড়ে গেল সেই উক্তিটি- ‘একজন মানুষ যখন লন্ডনে ক্লান্ত হয়, তখন তিনি জীবন থেকে ক্লান্ত। কারণ জীবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই লন্ডনে রয়েছে।’ আমি তো মাত্র এর ছিটেফোঁটা অবলোকন করেছি, ক্লান্ত হতে পারিনি। আরও বোধহয় রয়ে গেল বাকি!

এসইউ/এমএস