আন্তর্জাতিক

মেয়েদের জন্য নয়, তারপর...

বাংলা দেশের আরেকটি রেকর্ড- প্রথম বাঙালি মহিলা অভিযাত্রী দলের রন্টি শিখর জয়। এটি ১৯৬৭ সালের ৩১ অক্টোবরের কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার একটি খবরের শিরোনাম।

Advertisement

আট বাঙালি মেয়ের রন্টি পর্বতশৃঙ্গ অভিযান ছিল ভারতে প্রথম মেয়েদের শিখর ছোঁয়া। অনেকটা নিঃশব্দে ৫০ পূর্ণ করেছে সেই অভিযানের সাফল্যের দিনটা।

কিন্তু অর্ধশতাব্দী আগে সেদিন কেমন ছিল মেয়েদের জন্য পর্বতশৃঙ্গ অভিযানের স্বপ্ন দেখা? ফিরে দেখার চেষ্টা করেছে আনন্দবাজার।

সেদিনের অভিযানে নেতৃত্বে ছিলেন দীপালি সিংহ। রন্টি অভিযানের আগে তিনি একবার গিয়েছিলেন ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি রোয়িং ক্লাবে। ইচ্ছা ছিল সেখানে ভর্তি হওয়ার। তবে হাজার কাকুতি-মিনতিতেও কাজ হয়নি। কর্তৃপক্ষের সাফ জবাব ছিল, ‘এ সব স্পোর্টস মেয়েদের জন্য নয়।’

Advertisement

এই ‘মেয়েদের জন্য নয়’ শব্দবন্ধটার প্রতি তুমুল রাগ থেকেই পাহাড় পাড়ি দিয়েছিলেন দীপালি। তার আগে ক্লাবের গেটে আলকতারা দিয়ে বড় করে লিখে রেখে এসেছিলেন- ‘অনলি ফর বয়েজ।’

‘মাউন্টেনিয়ারিং’ শব্দটা সম্পর্কেও ধারণা ছিল না দীপালির। শ্রীশিক্ষায়তন কলেজে ভর্তির পর শব্দটার সঙ্গে পরিচয় হয় এনসিসিতে যোগ দেয়ার সুযোগ আসার পর।

১৯৬৪ সালে এনসিসি থেকে বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করতে পাঠিয়েছিল। দীপালির ঠাকুমা তখন চিন্তায় পড়েছিলন, এক মাস বাড়ির বাইরে থাকবে মেয়ে, বিয়ে দেব কী করে?

দীপালির ভাষায়, আসল অভিযান পাহাড়ে নয়, সমতলেই করতে হয়েছিল।

Advertisement

তবে মনোভাব ইতিবাচক ছিল দীপালির বাবা দেবেন্দ্রচন্দ্র সিংহের। এরপর ১৯৬৭ সালে দীপালির হাত ধরে তৈরি হয় ‘পথিকৃৎ মহিলা পর্বতারোহণ সংস্থা’। তত দিনে পর্বতারোহণের অ্যাডভান্সড কোর্স করা হয়ে গেছে দীপালির। হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের খাতা দেখে জোগাড় করেছেন কিছু বাঙালি মেয়ের নাম। এ ভাবেই স্বপ্না মিত্র (চৌধুরী), লক্ষ্মী পাল, শীলা ঘোষ, সুজয়া গুহ, স্বপ্না নন্দী, সুদীপ্তা সেনগুপ্ত (পরে দক্ষিণ মেরু অভিযান করে বিখ্যাত), ইন্দিরা বিশ্বাসরা এক হলেন পথিকৃতে। প্রথম বাঙালি মহিলা অভিযানের দিকে পা বাড়াল এক দল বাঙালি মেয়ে।

তবে বাধা এল ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশনের (আইএমএফ) তরফ থেকে। বলা হলো- অত বড় শৃঙ্গে মেয়েদের যাওয়া চলবে না! সিদ্ধান্ত হলো- নন্দাঘুন্টি নয়, রন্টি শৃঙ্গে অভিযান করতে পারবেন দীপালি। রন্টির উচ্চতা ১৯ হাজার ৯০০ ফুট।

১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর পা বাড়িয়েছিলেন আট পার্বতী। অত দিন আগে যোগাযোগ ব্যবস্থা যখন আধুনিক ছিল না- তখন কী অবস্থা হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়।

স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল ২৮ অক্টোবর। ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ মেঘলা আকাশে ভয়-ভয় চোখ রেখে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়েছিলেন চার জন। স্বপ্না মিত্র, স্বপ্না নন্দী, লক্ষ্মী পাল, শীলা ঘোষ। ঘণ্টা দুয়েক পরই শুরু তুষারপাত। কোমর অবধি বরফ ঠেলে এগোচ্ছেন সবাই। ক্লান্তিতে অবসন্ন শরীর।

সেদিনের কথা স্মরণ করে স্বপ্না মিত্র বলছিলেন, ‘ওরা তিন জন পারল না, শরীর খুব খারাপ করছিল ওদের। এ দিকে এক মুহূর্তের জন্য থামছে না বরফের কুচি-মেশা ঝোড়ো হাওয়া। শেরপারা জিজ্ঞেস করেছিলেন,পারবে তো, স্বপ্না?’

শেষ পর্যন্ত পেরেছিলেন স্বপ্না। একাই পেরেছিলেন ২৮ অক্টোবর দুপুর পৌনে ৩টায় রন্টি শৃঙ্গের চূড়ায় বাঙালি মেয়ের হাতে উড়ল ভারতের পতাকা।

স্বপ্ন জয়ের পর হাওড়ায় নামান দিনটার কথা স্মরণ করে দীপালি বলছিলেন, ‘ফুল-মিষ্টি-কার্ডের কথা তো ছেড়েই দিলাম। বাসে করে গোটা কলকাতা শহর ঘোরানো হয়েছিল আমাদের। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গিয়েছিল।’

১৯৭৪ সালে বিয়ে করেছেন দীপালি। ১৯৮৭ সালে করেছিলেন রুদ্রগয়রা অভিযান। আক্ষেপ আছে দীপালির। বললেন, ‘চেয়েছিলাম আরও অনেক মেয়েকে তৈরি করতে, চেয়েছিলাম অনেকে এগিয়ে আসুক। নিজের ফাউন্ডেশনও তৈরি করেছি। কিন্তু টাকা কই? আর, তেমন জেদি মেয়েই বা কই?

সূত্র: আনন্দবাজার।

এনএফ/এমএস