মতামত

হাত নয়, সন্তানের চোখের দিকে তাকান

অক্টোবরের ১ তারিখ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত গুগল সার্চে বাংলাদেশীদের ‘পিক পপুলারিটিতে’ উঠে এসেছে ব্লু হোয়েল। গুগল বলছে, বাংলাদেশী তরুণসহ মধ্য বয়স্কদের বেশিরভাগই গুগলে ‘ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ ডাউনলোড’ লিখে গেইমটি খুঁজেছে। খোঁজাখুঁজির তালিকায় শীর্ষে খুলনা বিভাগ আর তলানিতে ঢাকার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা।

Advertisement

পরিসংখ্যান যাই বলুক এটা সত্যি যে গত ২-৩ সপ্তাহ ধরে সংবাদমাধ্যম এবং ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্লু হোয়েলের সংবাদে সরগরম। হলি ক্রসের শিক্ষার্থী স্বর্ণার আত্মহত্যার পর মিডিয়ার ‘হট টপিক’ হয়ে দাঁড়ায় ব্লু হোয়েল। কেউ বলছে, বাংলাদেশে ছড়িয়েছে ব্লু হোয়েল। কেউ লিখছে, ভারত বা রাশিয়ার মতো আত্মহত্যার মিছিল হতে পারে বাংলাদেশেও।

হাতে টুথপিক, সূচ বা ব্লেড দিয়ে ছিদ্র করে তিমি মাছ আঁকা ব্লু হোয়েল খেলোয়াড়দের অন্যতম একটি উপসর্গ। গেমটির প্রথম দিকের লেভেলে এই চ্যালেঞ্জটি দেয়া হয়। অর্থাৎ যে এই গেমটি খেলবে এর কয়েকদিনের মধ্যেই তার হাতে তিমির ছবি আঁকার কথা। বাবা-মা’রা সহজেই হাত দেখে তাদের শনাক্ত করতে পারবেন। তাই তো?

আগের যুগের বাবা-মা’রা কম্পিউটারের ‘ক’ না বুঝলেও এযুগে এসব বোঝে না বা স্মার্ট ফোন চালাতে পারে না এমন সংখ্যা কম। ফেসবুকে ও পত্রিকায় এসব অনেক বাবা-মা’ই পড়েছেন। নিজেরা সচেতন হয়েছেন। সন্তানের দিকে খেয়াল রাখছেন। অনেক বাবা-মা সন্তাদের ব্লু হোয়েল খেলোয়াড় শনাক্তে শর্টকাটও নিচ্ছেন। ব্লু হোয়েলের সন্ধানে ছেলে-মেয়েদের হাত দেখছেন। কেউ সরাসরি কেউ আবার সন্তানকে বুঝতে না দিয়ে তার হাত দেখছে।

Advertisement

ব্লু হোয়েল গেমটি চাইলেই ডাউনলোড করা যায় না। খেলতে ও অ্যাডমিনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে প্রয়োজন কারিগরি ও ইংরেজির দক্ষতা। পরিবারের যে সন্তানটি ব্লু হোয়েল খেলে ধরে নিতে পারেন সে নিঃসন্দেহে অন্যদের চেয়ে চতুর বা ‘স্মার্ট’। আবার ওভার স্মার্টও বলা যায়। সন্তান যদি ব্লু হোয়েল খেলেই থাকে, তাহলে তা বাবা-মায়ের পক্ষে ধরা প্রায় ‘অসম্ভব’। তবে একটি পরীক্ষাতো করাই যায়। কৌশলে সন্তানের হাত দেখলেন।

পরীক্ষার পর দেখলেন সন্তানের বাম হাতে ব্লু হোয়েলের চিহ্ন নেই। কোন কাটা নেই। সম্পূর্ণ ফ্রেস। এবার কিছুটা স্বস্তিবোধ করছেন? স্বস্তিবোধ করারই কথা। কারণ অন্য যাই করুন সন্তান ব্লু হোয়েল খেলে না, অন্তত আত্মহত্যা করবে না। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত যে আপনার সন্তানের জীবনে কোন ‘ব্লু হোয়েল’ নেই?

একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকা বলেছে, ‘প্রাণঘাতী ব্লু হোয়েলের ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১৮০ জন আত্মহত্যা করেছে।’ যতদূর জানি ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে ১৮ বছরের পর পর খুব কম সন্তানই তার বাবা-মা’র সঙ্গে থাকে। ১৬ বছর থেকে নাকি নতুন বন্ধুদের সঙ্গে লিভ-টুগেদার করে। একাকীত্ব ঘোচাতে ব্লু হোয়েলের ফাঁদে পরে তারা আত্মহত্যা করছে। কিন্তু বাংলাদেশে কেন এমন হবে?

আমার মায়েরা ৭ ভাই-বোন। বাবার পরিবারে ৫ বোন, ৩ ভাই। আত্মীয়স্বজনের সবাই কমপক্ষে ৫ থেকে ১০ টি করে সন্তান। বেশি দিন নয়। এখন থেকে ৪০ বছর আগেও ৮ থেকে ৯ জন সন্তান নেই এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া দুরুহ ছিল। ১৯৭০-৮০’র কথা। বাবা-মা’য়ের কাছে শুনেছি, সেসময় টেলিভিশন ছিল হাতেগোনা কয়েকজনের ঘরে। বিনোদনের একমাত্র উৎস ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন, আর বেতার। সেসময়কার ছেলে-মেয়েরা ভাই-বোনের সঙ্গে খেলাধুলা করে সময় কাটাত। সারাদিন চলতো গল্পগুজব। তাদের গল্পগুজবের বিষয়টাও ছিল সমৃদ্ধশালী। প্যাঁচগুছ ছিল না।

Advertisement

কিন্তু এখনকার সন্তানদের কি সেই সুযোগ আছে? ফেসবুক, টুইটাটারের মতো আকর্ষণীয় সব বিনোদনের মাধ্যমগুলো আমাদের বাবা-মা’দের পরিবার-পরিকল্পনা নিয়ে আদৌ ভাবতে দিচ্ছে কি? এখনকার বাবা-মা’রা দিনে অফিস করেন। তারপর সংসারের কাজ। বাসায় ফিরেও অফিসের ফোন। অবসর সময়ে আবার ফেসবুকে পরিবার আত্মীয়স্বজনদের ছবি দেখেন, খোঁজ খবর জানেন। আরও কত ঝামেলা। ওদিকে সন্তানও স্কুল আর কোচিংয়ের চাপে ক্লান্ত প্রায়। অধিকাংশ বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে একমাত্র রাতে খাওয়ার টেবিলে একত্রিত হয়। অনেক বাবা-মা’র সেই সময়ও নেই। আপনার আছে কি?

আপনার কি মনে আছে সর্বশেষ রাতে খাওয়ার টেবিলে কয়দিন সন্তানের সঙ্গে বসে আড্ডা দিয়েছেন? হাসির ছলে জানতে চেয়েছেন তার বয় ফ্রেন্ড-গার্ল ফ্রেন্ড আছে কি না? জীবনে কয়টা প্রেম করেছে? প্রেমপত্র লিখে কি না? সানি লিয়নের গান দেখে কি না? খুব কমই বাবা-মা হয়তো এগুলো করেন। হয়তো ১% করেন কি না সন্দেহ। যদি সন্তানকে সময় না দেন তাহলে তাদের কি দোষ? সারাদিন স্কুল আর কোচিংয়ের চাপে ক্লান্ত আপনার সন্তান বিনোদনের জন্য কি করবে?

তখনই তাদের মাথায় আসে ‘ব্লু হোয়েল’ চিন্তা। এই ব্লু হোয়েল শুধু গেম নয়। এরা হচ্ছে সমাজের ব্লু হোয়েল। এই ব্লু হোয়েল হতে পারে আপনার সন্তানের অপরিচিত ফেসবুক ফ্রেন্ড, হতে পারে সন্তানের স্কুলের শিক্ষক, হতে পারে বড় ভাইয়ের কোন বন্ধু। এসব ব্লু হোয়েলরা সন্তানদের বাবা-মা’র কাছ থেকে প্রাপ্য বিনোদনটুকু দেয়। নিজেদের মতলব ফুরালে কেটে পড়ে। কেউ আবার ব্ল্যাকমেইল করে। এটাই আমাদের সন্তানদের আত্মহত্যার কারণ।

বাস্তবতা হচ্ছে, সমাজের এসব ব্লু হোয়েল’রা যদি সন্তানের টাইমপাসের (সময় কাটানোর) ব্যবস্থা করে দেয় তাহলেতো আপনার সন্তান ব্লু হোয়েলদেরকেই খুঁজবে। অষ্টম শ্রেণির স্বর্ণা যেদিন মারা যায় সেদিন থেকেই বাংলাদেশে কথা হচ্ছিল ব্লু হোয়েলের। স্বর্ণার আত্মহত্যার কারণ তার বাবা-মা হয়তো জানেন। কিন্তু পুলিশি তদন্তে এটা পরিষ্কার যে ব্লু হোয়েল গেইম তার জীবন নেয়নি। সমাজের কোন ব্লু হোয়েলের ফাঁদে পড়েছিল সে।

এভাবে যাতে আর কোন স্বর্ণা জীবন বিলিয়ে না দেয় সেই ব্যবস্থা না করে নতুন করে এখন তাদের হাত দেখা শুরু করেছি আমরা। শরীরে ব্লু হোয়েল খুঁজতে শুরু করেছি। কিন্তু একটা বারও সন্তানের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি যে সে কি চায়? আমার তাকে যতটুকু সময় দেয়া প্রয়োজন ততটুকুন দিচ্ছি কি না? যদি নাই দিয়ে থাকি তাহলে ব্লু হোয়েলের দোষ না দিয়ে সন্তানের এমন দশার জন্য নিজেদেরকেই দোষারোপ করা উচিৎ।

রোববার (১৫ অক্টোবর) দেখলাম হাইকোর্টে ‘ব্লু হোয়েল’ বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে রিট দায়ের করেছেন তিন আইনজীবী। নিঃসন্দেহে তাদের উদ্যোগটা প্রশংসনীয়। আদালত হয়তো গেইমটির ভয়াবহতা বিচার করে একটি সিদ্ধান্ত দেবেন। কিন্তু এতে কি সমাজের কোন লাভ হবে? এমন সিদ্ধান্তে যে ক্ষতি হবে না সেটা কি কেউ বলতে পারবেন?

সন্তান যদি ইন্টারনেটে ব্লু হোয়েল গেম কিংবা ব্লু হোয়েল’দের খুঁজে না পায় তাহলে বাবা-মা’ই বেশি বিপদে পড়বেন। এখন বাবা-মা’কে না পেয়ে অন্তত সন্তান ক্ষণিকের জন্য ব্লু হোয়েল’দের সান্নিধ্যটাতো পাচ্ছে। ওপারে যদি তারাও না থাকে তাহলেতো দম আটকাবে সন্তানের। ব্লু হোয়েলদের সন্ধানে তারা ঘরের বাইরে যাবে। তখন আপনার পক্ষে তাদের সামলানোটা হয়তো আরও কষ্টকর হতে পারে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু হোয়েল এক ছেলেকে শনাক্ত করে হেফাজতে নেয় পুলিশ। দীর্ঘ কাউন্সিলিংয়ের পর তাকে বাড়িতে পাঠানো হয়। তবে ব্লু হোয়েল থেকে দুরে রাখতে পুলিশের এই কাউন্সিলিং কি যথেষ্ঠ? যদি বাবা-মা কিংবা বন্ধুবান্ধবরা ছেলেটিকে দেখে রাখতেন সঙ্গ দিতেন তাহলে কি আদৌ একজন অজ্ঞাত অ্যাডমিনের কথায় ‘নাচতো’ ছেলেটি? উত্তরটা আমাদের সবারই জানা।

একজন বাবা-মা সন্তানের গর্ব। তেমনি সুসন্তানও বাবা-মার গর্ব। একজন গর্বিত বাবা-মা হতে সন্তানকে স্বশিক্ষিত করতে হবে। এজন্য তাদের সময় দিতে হবে। যদি বাবা-মা সন্তানকে সময় দেয় তাহলে সমাজের ব্লু হোয়েলরা তাদের কাছে কোন পাত্তাই পাবে না।

গুগল ট্রেন্ড ডাটা লিংক

লেখক : সাংবাদিক

এইচআর/আরআইপি