বছর দেড়েক আগে রাজশাহীর অভিজাত আবাসিক হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল থেকে উদ্ধার করা হয় প্রেমিক যুগলের মরদেহ। এদের শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। সম্প্রতি পুলিশের তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গ্রেফতার করেছে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত চার যুবককে। তারাই এ চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন।
Advertisement
গ্রেফতারকৃতরা হলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাহাত মাহমুদ (২১), রাজশাহী কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বোরহান কবীর উৎস (২২), একই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আল-আমিন (২০) ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ভর্তি প্রার্থী আহসান হাবিব রনি (২০)।
গ্রেফতারকৃত রাহাত সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার খোর্দ্দ গজাইদ গ্রামের আমিরুল ইসলামের ছেলে। রনি পাবনার ফরিদপুর উপজেলার এনামুল হক সরদারের ছেলে। রাজশাহীর পবা উপজেলার জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের টিপু সুলতানের ছেলে আল-আমিন। আর উৎস নাটোরের লালপুর উপজেলার উত্তর লালপুর গ্রামের শফিউল কালামের ছেলে।
গত ১৮ অক্টোবর রনিকে ঢাকার মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পিবিআই। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন রাজশাহী নগরীর দুটি ছাত্রাবাস থেকে গ্রেফতার করা হয় বাকি তিনজনকে। এরপর গত ২০ অক্টোবর রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাহিদুল ইসলামের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রনি। এরপর ২৩ অক্টোবর কুদরাত-ই-খুদার আদালতে জবানবন্দি দেন আরেক অভিযুক্ত উৎস।
Advertisement
পিবিআই'র তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, সুমাইয়ার সঙ্গে অভিযুক্ত রাহাতের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। সেই সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর মিজানুরের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান ওই ছাত্রী। বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হন রাহাত। এরপরই বন্ধুদের নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হোটেলের কক্ষে গিয়ে দুজনকে হত্যা করেন এ প্রেমিক যুগলকে।
প্রথমে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় প্রেমিক মিজানুর রহমানকে। এরপর প্রেমিকা সুমাইয়া নাসরিনকে হত্যা করা হয় বালিশ চাপায়। এর আগে অভিযুক্তরা তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন। ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পরে মিজানুরের মরদেহ ঝুলিয়ে দেয়া হয় ফ্যানের সঙ্গে।
জিজ্ঞাসাবাদে রনি জানান, মিজানুরের সঙ্গে অভিযুক্ত রনির পরিচয় ২০১৪ সাল থেকে। ওই সময় তিনি উল্লাপাড়ায় মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে গিয়ে একটি মেসে ওঠেন। তার পাশেই আরেক মেসে থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করতেন মিজানুর। নিজের মেসের খাবার ভালো না হওয়ায় রনি মিজানুরের মেসে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করতেন। সে সূত্রেই তাদের পরিচয়।
উচ্চ মাধ্যমিক শেষে মিজানুর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আর বরেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য রাজশাহী আসেন রনি। নতুন করে তাদের আবারও যোগাযোগ হয়। রাজশাহী নগরীর রিলাক্স মেসে থাকতে গিয়ে আরেক অভিযুক্ত রাহাতের সঙ্গে রনির পরিচয় হয়। আর রাহাতের পূর্ব পরিচিত উৎস ও আল-আমিন থাকতেন নগরীর সোনাদীঘি এলাকার নকশি বাজার ছাত্রাবাসে।
Advertisement
রাহাত জানান, সুমাইয়ার সঙ্গে রনির পরিচয় ছিল। রনির দেয়া মুঠোফোন নম্বরে সুমাইয়ার সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন তিনি। এক পর্যায়ে তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান রাহাত। চার থেকে পাঁচ মাস দীর্ঘ ছিলো তাদের সেই সম্পর্ক। এরপর মিজানুরের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান সুমাইয়া।
রনি আরও জানিয়েছেন, নগরীর বিনোদপুরের বায়তুল আমান ছাত্রাবাসে থাকতেন রাহাত। হত্যাকাণ্ডের দুই থেকে তিন দিন আগে রনি সেখানে যান। অভিযুক্ত আল-আমিন ও উৎস ছিলেন সেখানে।
তারা চারজন মিলে তাস খেলছিলেন। এক পর্যায়ে সুমাইয়ার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন করে মিজানুরের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর কথা জানান রাহাত। এই প্রেমিক জুটিকে হাতেনাতে ধরতে রাহাত অন্যদের সাহায্য চান।
হত্যাকাণ্ডের আগেরদিন রনিকে ফোন দিয়ে মিজান জানান, তার ভাই ও ভাবি রাজশাহীতে আসছেন। তাদের থাকার জন্য ভালো আবাসিক হোটেলের সন্ধান চান তিনি। কিন্তু রনি জানতে পারেন ভাই-ভাবি নয়, সুমাইয়া রাজশাহী আসছেন। এরপর বিষয়টি তিনি রাহাতকে জানান।
রনির দেয়া তথ্যের বরাত দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, রনিকে ফোন করে ঘটনার দিন মিজান ও সুমাইয়াকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দেখার কথা জানান রাহাত। এরপর রাহাতের ডাকে তিনি বিনোদপুরে যান। সেখানে ছিলেন আল-আমিন ও উৎস।
দূর থেকে রাহাত সুমাইয়া ও মিজানুরকে দেখিয়ে তাদের অনুসরণ করতে বলেন। মিজান ও সুমাইয়া অটোরিকশায় উঠে হোটেল নাইসে এসে পৌঁছান। পরে তাদের অনুসরণ করে সেখানে পৌঁছান ওই চারজন।
এরপর রাহাত ও রনি হোটেলের এক বয়কে হাত করেন। এরপর তিনতলা মার্কেটের ছাদ হয়ে জানালা দিয়ে হোটেল নাইসের ৩০৩ নম্বর কক্ষে ঢোকেন। সেখানে তখন শুধু সুমাইয়া একাই ছিলেন। তার সঙ্গে রাহাত ও রনির কথাকাটাকাটি হয়। তাদের চাপে মিজানুরকে ফোন করে ডেকে আনেন সুমাইয়া।
এরপর সেখানে মিজানুর এলে ওই চারজন তাকে বেধড়ক পেটান। এদের কেউ একজন হোটেলের টি টেবিল ভেঙে তার পায়া দিয়ে মিজানুরের মাথায় আঘাত করেন। এতে মিজানুর পড়ে গেলে তার দুই হাত বেঁধে ফেলা হয় সুমাইয়ার ওড়না দিয়ে। আরেকটি ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় মিজানুরকে।
অভিযুক্ত ওই চার যুবক বলেন, মিজানুরের মরদেহ মেঝেতে রেখেই সুমাইয়াকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন তারা। এরপর বালিশ চাপা দিয়ে তাকেও হত্যা করেন। দুজনকে হত্যার পর মিজানের মরদেহ ওড়না দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেন অভিযুক্তরা। এরপর তারা আবারও জানালা দিয়েই পাশের মার্কেটের ছাদ হয়ে বেরিয়ে যান।
এর আগে একবছরের তদন্ত শেষে গত মে তে নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানা পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। তাতে বলা হয়, সুমাইয়াকে ধর্ষণ করেন মিজানুর। ডিএনএ টেস্টে সুমাইয়ার শরীরে শুধুমাত্র মিজানুরের ডিএনএ পাওয়া যায়।
পরে তাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে তার মাথায় আঘাত করা হয়েছে। আর এ ঘটনা ঘটিয়েছেন মিজানুর নিজেই। পরে তিনিও আত্মহত্যা করেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে সুমাইয়াকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং মিজানুরের আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করা হয়।
তবে পিবিআই'র তদন্তে বিষয়টি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এনিয়ে পুলিশের তদন্তে গাফেলতি এবং ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং ডিএনএ পরীক্ষার ফলেও ত্রুটি দেখছে পিবিআই। সম্প্রতি আদালতের নির্দেশে পিবিআই মামলাটি পুর্নতদন্ত করে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজশাহী পিবিআই এর উপপরিদর্শক (এসআই) মহিদুল ইসলাম বলেন, ওই কক্ষ পাওয়া গেছে তিন ‘ব্র্যান্ডের’ সিগারেটের ফিল্টার। তাছাড়া মিজানুরের মরদেহ ফ্যানের সঙ্গে ঝোলানো থাকলেও তার দুই হাত বাঁধা ছিলো ওড়না দিয়ে। তার প্যান্ট কোমর থেকে ভাঁজের মতো করে নিচে নামানো ছিলো। তা দেখে মনে হচ্ছিলো কেউ একজন টান দিয়ে নামিয়েছে। তাছাড়া নিহতের গলার দুই পাশে দাগ ছিলো। আত্মহত্যা করলে সেই দাগ একদিকে হওয়ার কথা। আলামত দেখে তখনই তিনি নিশ্চিত হন-এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার পর তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলার তদন্তভার পিবিআইকে দেন। তদন্তের শুরুতেই পিবিআই নিবিড়ভাবে সুমাইয়া ও মিজানুরের মুঠোফোনে কথোপকথন পর্যবেক্ষণ করে। সেখানেই সনাক্ত করা যায় রনিকে। এরপর তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিকে গ্রেফতার করা হয় অন্যদের। যথেষ্ট আলামত থাকা সত্ত্বেও থানা-পুলিশ মামলাটি যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি বলে মনে করেন এই তদন্ত কর্মকর্তা।
তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) সেলিম বাদশা দাবি করেন, তদন্তে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা মেলেনি। ফলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, সিআইডির ডিএনএ টেস্টের প্রতিবেদন এবং রাসায়নিক পরীক্ষার ভিত্তিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। তদন্তে অবহেলার অভিযোগ অস্বীকার করেন এই কর্মকর্তা।
অন্যদিকে, নিহত মিজানুর ও সুমাইয়ার মরদেহের ময়নাতদন্তকারী রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক এনামুল হক বলেন, ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন মিজানুরের গলায় যে দাগ আছে সেটা আত্মহত্যারই। তিনি পরীক্ষা করে যা পেয়েছেন তার ভিত্তিতেই প্রতিবেদন দিয়েছেন।
গত বছরের ২২ এপ্রিল রাজশাহী নগরীর হোটেল নাইসের ৩০৩ নম্বর কক্ষ থেকে মিজানুর রহমান ও তার প্রেমিকা সুমাইয়া নাসরিনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মিজানুরের মরদেহ ওড়না দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝোলানো ছিল। আর সুমাইয়ার মরদেহ ছিল বিছানায়। মরদেহ উদ্ধারের সময় কক্ষটির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিলো।
নিহত মিজানুর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার উমেদ আলীর ছেলে। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন মিজানুর। আর সুমাইয়া ছিলেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তারা বাবা আব্দুল করিম পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই)।
বর্তমানে তিনি গাইবান্ধা বি সার্কেলে কর্মরত। তার পরিবার থাকে বগুড়ায়। তিন বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে সুমাইয়া ছিলেন দ্বিতীয়। ঘটনার পর সুমাইয়ার বাবা বাদী হয়ে রাজশাহীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। এ হত্যাকাণ্ডের ন্যায় বিচার চায় নিহতদের পরিবার।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/এমএএস/আইআই