মতামত

বিসিএস পদ্ধতির ত্রুটি ও সুবর্ণাদের স্বপ্নভঙ্গের বাস্তবতা

গত কয়েকদিন যাবত জাগো নিউজের একটি সংবাদ সামাজিক যােগাযোগ মাধ্যমে বেশ শেয়ার হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৪০ হাজারের বেশি পাঠক 'পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন ডা. সুবর্ণা' এই শিরোনামের সংবাদটি অনলাইনে শেয়ার করেছেন। ডা. সুবর্ণা শামীম আলো'র গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা হওয়াতে আমার আরেকটু বেশি আগ্রহ জন্মালো, নিজের এলাকা বা আপনজন কেউ ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করলে সেই সাফল্য নিজের মনে হয়। কিন্তু আজ আমি ডা. সুবর্ণা কিভাবে নিজের মেধার অবমূল্যায়ন করেছেন শুধুমাত্র রাষ্ট্রের পদ্ধতিগত ভুলের কারণে সেই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করবো।

Advertisement

ডা. সুবর্ণার পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হওয়ার সংবাদটি শেয়ার দিয়ে আমার বন্ধু হুমায়রা চৌধুরী ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, "এই হচ্ছে বিসিএস পরীক্ষার পদ্ধতিগত ত্রুটি। ডাক্তার নিজেদের ক্যাডারে যাবেন, যেমন যাবেন ইঞ্জিনিয়াররা। পরে কী দেখি আমরা? সব অ্যাম্ব্যাসি আর হাইকমিশনে লোকজনের খারাপ ব্যবহার, অদক্ষতা আর কাজে ভীষণ অমনোযোগ। সবচেয়ে আসল কথা, অদক্ষতা। জানি না এ দেশের ভবিষ্যৎ আসলে কী। তিলে তিলে সিস্টেমগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে।"

হুমায়রার কথার সাথে বাস্তবতার অসম্ভব মিল খুঁজে পাওয়া গেছে এমন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছি। বর্তমানে লন্ডনে যিনি হাই কমিশনারের দায়িত্বে রয়েছেন তিনিও সুবর্ণার মতো মেডিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে পররাষ্ট্র ক্যাডারে এসেছেন। তার দীর্ঘ কূটনৈতিক ক্যারিয়ারের পর তিনি বর্তমানে লন্ডনে হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি লন্ডনে এসেই আমার এক সংবাদ যথাযথ নিয়ম মেনে করা হয়নি এমন অভিযোগ দিয়ে প্রেস মিনিস্টারের মাধ্যমে লন্ডন হাইকমিশনে সাংবাদিক হিসেবে আমার সংবাদ সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ করে দিলেন। যদিও তিনি পরবর্তীতে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। সম্ভবত নাজমুল কাওনাইনই একমাত্র বাংলাদেশি হাইকমিশনার যিনি কোনো সাংবাদিককে লিখিত ভাবে বিদেশি দূতাবাসে সংবাদ সংগ্রহ করতে নিষেধাজ্ঞা জানিয়েছিলেন।

হুমায়রা তার স্ট্যাটাসে 'অদক্ষতা'র বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ব্রিটেনের টেলিভিশন বা সংবাদপত্রে কোনো সংবাদ ভুলভাবে উপস্থাপিত হলে সেটি প্রতিবাদ জানানোর যেমন নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে তেমনি বাংলাদেশেও রয়েছে প্রেস কাউন্সিল। কিন্তু হাই কমিশনার বা প্রেস উইং সেই পদ্ধতি অনুসরণ না করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাংবাদিক হিসেবে আমাকে নিষিদ্ধ করে দিলো। হাই কমিশনার বা তার প্রেস টিম যদি জানতো ভুল সংবাদ পরিবেশিত হলে প্রেস কমপ্লেইন কমিশন বা অফকমে কমপ্লেইন করতে হয় তাহলে তারা সেই ভুল করতো না। শুধু লন্ডনই নয়, বিদেশি মিশনে এমন অদক্ষতার বহু নজির আমরা প্রায়ই খবরের কাগজে দেখতে পাই।

Advertisement

তবে আমি এটাও বলছি না যে ডা. সুবর্ণা বিদেশি মিশনে গিয়ে এমন অদক্ষতার পরিচয় দেবেন। ডা. সুবর্ণা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের একজন। লন্ডনের বর্তমান হাইকমিশনারও বাংলাদেশের সেরা মেধাবীদের একজন। প্রশ্নটি হচ্ছে, সঠিক ব্যক্তি তার সঠিক কাজটি করছেন কিনা। শিক্ষা জীবনের শুরুতেই তো সুবর্ণা ডাক্তারি পড়ে মানবসেবা করবেন বলে স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন।২০১৩ সালে সুবর্ণা ডাক্তার হয়েছেন, তারপর এফসিপিএস পার্ট ১ সম্পন্ন করেছেন। প্রায় অর্ধযুগের বেশি সময় ধরে ডাক্তারি বিদ্যা পড়তে পড়তে কি তাহলে সুবর্ণার মানবসেবার স্বপ্ন ভঙ্গের বাস্তবতা তৈরি হয়েছিলো যে তাকে ২০১৫ সালে এসে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে পররাষ্ট্র ক্যাডারে ক্যারিয়ার পরিবর্তন করতে হলো?

আর সুবর্ণা যদি মনে করেন তার লক্ষ্য তিনি বিসিএস'র মাধ্যমে পররাষ্ট্র ক্যাডারে ক্যারিয়ার গড়বেন তাহলে তার উচিত হয়নি রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় করে ডাক্তারি পড়া। এই আসনটিতে আরেকজন মেধাবীর সুযোগ তৈরি হতে পারতো অথবা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে সুবর্ণা নিজের পেশায় ভালো সেবা দিতে পারতো। সুবর্ণাদের স্বপ্নভঙ্গ হলো কেন সেই প্রশ্ন খোঁজার চেয়ে জরুরি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা পদ্ধতি বদলানো। শুধু পররাষ্ট্র ক্যাডারই নয় পুলিশ ও প্রশাসনের মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে হবে। সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের মাধ্যমে প্রত্যেক প্রার্থীকে যোগ্য করে গড়ে তোলা হয় তেমনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনে প্রয়োজনে পিএসসি'র অধীনে আলাদা ইনস্টিটিউট তৈরি করে নিয়োগের আগেই বিশেষ কোর্সের মাধ্যমে দক্ষ শিক্ষার্থী বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।

যদিও সাভারে প্রশিক্ষণ একাডেমির মাধ্যমে পিএসসি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে, তবুও শিক্ষার্থীকে তার শিক্ষা জীবনের শুরুতেই তার পেশাগত গন্তব্যের জন্য পথ তৈরি করে দিতে হবে। বর্তমান ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যমে একজন তথ্য কর্মকতার যে কতটা প্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞান রাখতে হয় সেটা হয়তো অন্য ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থীর পক্ষে অনুমান করা সহজ নয়। কিন্তু আমরা দেখছি তথ্য ক্যাডারের নিয়োগ প্রাপ্তদের অনেকেরই তথ্য ও যোগাযোগ মাধ্যম সম্পর্কে তেমন কোন প্রফেশনাল ডিগ্রি বা প্রশিক্ষণ থাকে না।পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আরো একটি বড় দুর্বলতা সময় ক্ষেপণ। ৩৬ তম বিসিএস-এর পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা হয়েছে ১৭ অক্টোবর কিন্তু পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছিলো ৩১ মে ২০১৫ সালে। সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) এমন এক পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করেছে যার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আড়াই বছর লেগে যায়। পৃথিবীতে এতো দীর্ঘ মেয়াদি পরীক্ষার নজির আর কোনো দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই!

আমাদের জেনারেশনে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয়, তৃতীয় বর্ষে উঠলেই বিসিএস'র জন্য পড়াশোনা শুরু করে দিতো। নীলক্ষেত থেকে গুরুগৃহ বই, অথবা প্রিলিমিনারি টেস্ট গাইড কিনে দরজা বন্ধ করে সাধারণ জ্ঞান আর ভোকাবিউলারি মুখস্থ করতো। ইদানিং বাজারে নাকি 'এমপি থ্রি' গাইড ব্যাপক জনপ্রিয়। গান যেমন এমপি থ্রিতে কমপ্রেস করে ঢুকিয়ে রাখা হয়, ওই বইতেও নাকি তেমনি জ্ঞানকে 'এমপি থ্রি' ফরম্যাটে লিপিবদ্ধ করে দেয়া হয়, শিক্ষার্থীরা ওই বই মুখস্থ করলেই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রিলিতে টিকে যাবে। এসব বইতে লেখা আছে কত কত অজানা তথ্য। ঘোড়াশালে সার কারখানা কবে স্থাপিত হয়েছিলো, বাংলাদেশে পাটকল কয়টি, ইরি আর বিরির এব্রিভিয়েশনসহ নানা অজানা প্রশ্ন।সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) এর কর্তাব্যক্তিরা মনে করেন এমন সাধারণ জ্ঞান যাদের রয়েছে তারাই দেশের প্রকৃত মেধাবী। মেধা মূল্যায়নের এমন অলৌকিক পদ্ধতি শুধু বাংলাদেশেই দেখা যায়।

Advertisement

শুধু পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা পদ্ধতি ত্রুটি নিরসনেই প্রকৃত সমাধান নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ শিক্ষার্থীই তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পড়ছে। যে ছেলেটি পড়তে চেয়েছিলো আইন বা সাংবাদিকতা, সে হয়তো ভর্তি পরীক্ষায় ৫ নাম্বার কম পেয়েছে তাই তার মেধা তালিকায় আইন বা সাংবাদিকতা বিষয়টি বেছে নেওয়ার সুযোগ হয়নি। তাকে পড়তে হচ্ছে রাজনীতি, বিজ্ঞান কিংবা ইতিহাস। এখন ৫/৬ বছর ওই শিক্ষার্থী তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ইতিহাস পড়ে গেলো, আর যিনি আইন বা সাংবাদিকতায় ভর্তি হয়েছিলেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে কোনো একটা ব্যাংকে চাকরি নিয়ে নিলেন। ব্যাংকই যদি তার গন্তব্য হবে তবে ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষা জীবনের যে ৫/৬ বছর আইন আর সাংবাদিকতায় কেন পড়লো? রাষ্ট্র যে তার পেছনে অর্থ ব্যয় করলো তার কি হবে? এভাবেই এক দুষ্টচক্রে আটকে গেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।

এই লেখা যখন লিখছি তখন আরেকটি সংবাদ দেখলাম, মেডিক্যালে ভর্তিযুদ্ধে প্রথম হয়েছেন মাহমুদ। ৮৩ হাজার ৭৮৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাহমুদুল হাসান প্রথম হয়েছেন। মাহমুদ নিঃসন্দেহে দেশের সেরা মেধাবীদের একজন। সেনাবাহিনীতে চাকরি করার ইচ্ছা ছিলো মাহমুদের। ইন্টার সার্ভিস সিলেকশন বোর্ড মাহমুদকে যোগ্য মনে করেনি, তাই মাহমুদ এখন ডাক্তার হবার স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছেন। তারই প্রাথমিক সাফল্য মাহমুদের মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ। পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম ডা. সুবর্ণা হয়তো মাহমুদের রোল মডেল, কেননা ডাক্তারি পড়েই তো সুবর্ণা পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন।

আমি জানিনা, শেষ পর্যন্ত মাহমুদের গন্তব্য কোথায় হবে। মাহমুদের মতো হাজারো তরুণ যারা আজ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবার জন্য মেডিক্যাল কিংবা বুয়েটে ভর্তি হয়েছে তারা হয়তো দিনশেষে সুবর্ণাদের মতো সুযোগ পেলে পররাষ্ট্র ক্যাডারেকে বেছে নেবেন। তবে শিক্ষা ব্যবস্থার এই অসঙ্গতি আর ত্রুটি ঠেকানো না গেলে প্রকৃত মেধাবীদের সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে আমরা ব্যর্থ হবো।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। কারেন্ট এফেয়ার্স এডিটর, চ্যানেল এস টেলিভিশন লন্ডন ও একাত্তর টেলিভিশনের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি।

এইচআর/আইআই