মতামত

রাজনীতি থেকে একজন ভদ্রলোকের বিদায়

ছিলেন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের দাপুটে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি। কিন্তু পরে মিশতে গিয়ে দেখেছি যে অর্থে দাপুটে বুঝি আমরা, তেমনটা তিনি নন। বরং নিরহঙ্কার, ব্যক্তিত্ববান একজন নরম মানুষ হিসেবেই চিনেছি এম কে আনোয়ারকে। সকালে তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল, স্মৃতিকাতর পুকুরে ঢিল পড়লো।

Advertisement

১৯৯৬ সালে আমি ভোরের কাগজের রিপোর্টার। বিট ছিল নির্বাচন কমিশন। সপ্তম সংসদ নির্বাচনের পর বিট বদলে হয়ে গেল সংসদ। মিরপুরের বাসা থেকে নির্বাচন কমিশন বা সংসদ হয়ে বাংলামোটরের অফিসে যেতাম। আওয়ামী লীগ-বিএনপির সক্রিয় ও সরব উপস্থিতিতে সপ্তম সংসদের শুরুটা ছিল দারুণ প্রাণবন্ত। যুক্তি-তর্ক, ওয়াকআউট সব মিলিয়ে প্রতিদিনই ইভেন্ট। সংসদ থেকে চোখ সরানোর উপায় ছিল না। একটু আশপাশে গেলেই কিছু না কিছু মিস হয়ে যেতো।

একদিকে তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ সেলিম; অন্যদিকে বি চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, এম কে আনোয়াররা। এমনকি বিএনপির এক ব্যাক বেঞ্চার সাংসদ কক্সবাজারের খলিকুজ্জামানও বক্তব্য দিয়ে একদিন সংসদ মাতিয়ে দিয়েছিলেন। পরদিন যা অধিকাংশ পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল। পরে খলিকুজ্জামান আমাকে বলেছেন, ‘একদম না চিনেই যে সাংবাদিকরা আমার মত একজন ব্যাক বেঞ্চারের বক্তব্য কাভার করেছে, তাতে আমি বিস্মিত হয়েছি।’

তখন স্পিকার ছিলেন হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার ছিলেন আজকের রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আব্দুল হামিদ। অধিবেশন না থাকলেও সংসদ থাকতো নিউজের আগ্রহে, দারুণ সক্রিয় ও কার্যকর ছিল সংসদীয় কমিটিগুলোও। বি চৌধুরীর নেতৃত্বে একবার স্পিকারের পোডিয়াম পর্যন্ত তেড়ে গিয়েছিলেন বিএনপির সাংসদরা। স্পিকারের পোডিয়াম পর্যন্ত তেড়ে যাওয়াটা ঠিক নয়; কিন্তু এখনকার নিরুত্তাপ সংসদ দেখে সেই অন্যায্য উত্তাপটুকুও মিস করি আমরা।

Advertisement

সপ্তম সংসদের শুরুতে সংসদীয় কমিটি গঠন নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। তখনই এম কে আনোয়ারের সাথে আমার পরিচয়। এই সঙ্কটে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করতেন তিনি। পেশাগত কাজে অনেকবার তাঁকে জ্বালিয়েছি, তাঁর বাসায় গেছি। তিনি ছিলেন আমার পাশের উপজেলার মানুষ। সব মিলিয়ে একটা অন্যরকম ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তাঁর কাছে রাজনীতি, সংসদের বিভিন্ন খবর যেমন পেয়েছি; তেমনি পাঠ নিয়েছি সংবিধান, কার্যপ্রণালী বিধি ও সংসদীয় রীতিনীতির। এই প্রসঙ্গে আরো কয়েকজন শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। বিএনপির সাবেক মহাসচিব, তখনকার বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন; আওয়ামী লীগের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, এডভোকেট রহমত আলী, সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী, এখনকার ডেপুটি স্পিকার তখনকার জাতীয় পার্টির সাংসদ এডভোকেট ফজলে রাব্বি, সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুল হক- ওনাদের কাছে ছাত্রের নিষ্ঠায় শিখেছি সংসদীয় রীতিনীতি।

সুরঞ্জিতদা তখন ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা। আমিও প্রায় প্রতিদিন সংসদে যেতাম। কিছু বুঝতে অসুবিধা হলেই তাদের কারো না কারো রুমে ছুটে যেতাম। সপ্তম সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী আইন-কানুন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সম্পর্কে শিখেছি তখনকার নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা, কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব এখনকার অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, কমিশনের তখনকার উপসচিব (আইন) পরে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদের কাছে। সবসময় তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতেন না বা কোনো খবরই দিতেন না। তবে কিছু শিখতে চাইলে শেখাতেন ধৈর্য্য নিয়ে।

কিন্তু পরবর্তীতে সংসদ বর্জন এবং আরো পরে নির্বাচন বর্জনের অপসংস্কৃতি আামাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের উত্তাপ কেড়ে নিয়েছে। মানলাম প্রধান বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সংসদীয় গণতন্ত্রকে ‘অপরিপক্ক’ বলে মহা অন্যায় করেছেন। সরকারি দলের সাংসদরা খুব ক্ষেপেছিলেনও বটে, কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো ১৯৯১ সালের পর থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র এগিয়েছে না পিছিয়েছে? স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর সংসদীয় গণতন্ত্রকে ‘অপরিপক্ক’ বলা হয়তো সময়ের বিবেচনায় অযৌক্তিক, কিন্তু অকার্যকর বললে আশা করি কেউ মাউন্ড করবেন না। সংসদীয় গণতন্ত্রকে আজকের আইসিইউতে নিয়ে আসার দায় যতটা বিএনপির, ততটাই আওয়ামী লীগের। দুই দল পাল্লা দিয়ে সংসদ বর্জন করেছে।

বলছিলাম এম কে আনোয়ারের কথা। কাছ থেকে দেখে জেনেছি, ক্যারিয়ার আমলা হলেও তিনি একজন ঝানু পার্লামেন্টরিয়ানও ছিলেন। ৫ বারের সংসদ সদস্য এম কে আনোয়ার নিজের প্রজ্ঞা দিয়ে সংসদকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি তর্ক করতেন যুক্তি দিয়ে, বিরোধিতা করতেন আদর্শিক অবস্থান থেকে। তাঁর আদর্শের সাথে আপনার দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু তার প্রজ্ঞার কাছে, যুক্তির প্রতি আপনার শ্রদ্ধা আসবেই। এমনকি অফ দ্যা রেকর্ডেও তাকে কখনো অসংসদীয় কথা বলতে শুনিনি। তিনি ছিলেন পুরোপুারি একজন ভদ্রলোক। একদম প্রচলিত রাজনীতিকদিবদের মত নয়।

Advertisement

এম কে আনোয়ারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। অভিযোগটি কিন্তু সত্যি। রাজনৈতিক আকাঙ্খা থেকে তিনি আমলা থাকার সময়ই তাঁর এললাকা হোমনায় ব্যাপক উন্নয়ন কাজ করেছিলেন। সত্যি বলতে কি, পিছিয়ে থাকা হোমনাকে তিনি একদমই বদলে দিয়েছিলেন। এতটাই বদলেছিলেন, নির্বাচনে তাঁর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ দাঁড়াতেই পারতেন না। দাঁড়ালেই পাস। আমলা থাকতেই তিনি এলাকার নির্বাচনী মাঠ অসমতল করে এসেছিলেন। কিন্তু এই বিষয়টিকে আমি অত নেতিবাচকভাবে দেখি না। বাংলাদেশের সব উপজেলায় সরকারি কর্মকর্তা আছেন। রাজনীতি করুন আর না করুন, তারা সবাই যদি নিজ প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নে এগিয়ে আসেন দেশটাই পাল্টে যেতে পারে। আর শুধু এম কে আনোয়ার নন, সামরিক-বেসামরিক অনেক কর্মকর্তাই মনে রাজনীতির গোপন আকাঙ্খা থেকে এলাকার উন্নয়নে কাজ করেন। অনেকেই ক্ষমতার অপব্যবহার করেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। কিন্তু এম কে আনোয়ার সেটা করেছিলেন তাঁর এলাকার স্বার্থে।

রাজনীতি করবেন বলে পাল্টে দিয়েছিলেন হোমনাকে। তিনি কাজ দিয়েই জনগণের হৃদয় জয় করেছিলেন। প্রচলিত রাজনীতিবিদদের মত তাঁর বিরুদ্ধে মাস্তান পোষা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু এই ভদ্রলোককে রাজনীতি কী ফিরিয়ে দিল? প্রায় ৯০ বছর বয়সে এসে তাকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক সহিংসতার মামলায় জেল খাটতে হয়েছে। এম কে আনোয়ার কাউকে পেট্রোল বোমা মারার নির্দেশ দিয়েছেন, এটা মরে গেলেও আমি বিশ্বাস করবো না। এমনকি দলের কোনো ফোরামে এ ধরনের আলোচনায় নিশ্চয়ই তিনি বাধা দিয়েছেন। কিন্তু সেই এম কে আনোয়ারকেই সহিংসতার মামলায় জেল খাটতে হয়েছে। এম কে আনোয়ারের জেল খাটা দেখেই বোঝা যায়, সরকার অনেক মামলা দিয়েছেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে। এম কে আনোয়ারের এই পরিণতি দেখার পর যদি ভদ্রলোকেরা রাজনীতিতে আসতে নিরুৎসাহিত হন, দায় কার? এরপর খালি মাস্তান আর ব্যবসায়ীরাই রাজনীতি করবে?

সপ্তম সংসদের ঐ সময়টায় অনেকবার এম কে আনোয়ারের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় গেছি। এখন তো সেখানে শেলটেকের বিশাল ভবন। তখন বাসাটি ছিল দোতলা, ছিমছাম। অনেকবার এমন হয়েছে সংসদ ভবন বা নয়াপল্টন থেকে আমাকে বাংলামোটরের অফিসে নামিয়ে দিয়ে এম কে আনোয়ার তাঁর এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় যেতেন। অবশ্য মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর সাথে আর যোগাযোগ ছিল না। একবার প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে দেখা হতেই বললেন, আপনি এখন আর আসেন না কেন? আমি তাঁকে বলতে পারিনি, মন্ত্রী এম কে আনোয়ারের কাছে আমার কোনো কাজ ছিল না। তাই তাঁকে বিরক্ত করতে যাইনি।

এম কে আনোয়ার প্রসঙ্গে একটি মজার স্মৃতি দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। একদিন ভোরের কাগজের তখনকার সম্পাদক মতিউর রহমান বললেন, এম কে আনোয়ারকে একটু ধরাইয়া দাও তো। তখনও মোবাইলের তেমন প্রচলন ছিল না। মতি ভাইয়ের রুমের ল্যান্ডফোন থেকেই এম কে আনোয়ারের বাসায় ফোন করলাম। তার সাথে আমার শর্ত ছিল, কথা বলুন আর না বলুন; আমার ফোন যেন ধরেন। ফোন ধরে আমি তার কুশলাদি জেনে বললাম, আনোয়ার ভাই মতি ভাই একটু কথা বলবেন। মতি ভাই ফোন নিয়েই বললেন, স্যার কেমন আছেন? সম্পাদক যাকে স্যার বলেন, আমি তাকে ভাই বলি! নিজের বেয়াদবিতে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলাম। পরে অবশ্য ভেবে দেখেছি, মতি ভাই তাঁকে দেখেছেন দাপুটে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি হিসেবে। আর আমার সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছে পাশের এলাকার বিরোধী দলের সংসদ সদস্য হিসেবে। তবে তাঁকে ভাই বললেও তাঁর প্রজ্ঞার প্রতি, সততার প্রতি, যুক্তিনিষ্ঠতার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ছিল।

জাতি সত্যি একজন ভদ্রলোক রাজনীতিবিদ হারালো।

২৪ অক্টোবর, ২০১৭

probhash2000@gmail.com

এইচআর/পিআর