টেস্টের পর দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়ানডেতেও তুলোধুনো মুশফিক, তামিম, সাকিব , মাহমুদউল্লাহ ও মাশরাফিরা। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ২-০'তে হোয়াইটওয়াশ। এরপর তিন ম্যাচ সিরিজে তুলোধুনো (১০ উইকেট, ১০৪ রান ও ২০০ রানে হার)।
Advertisement
মাঝে শ্রীলঙ্কার মাটিতে লঙ্কানদের বিপক্ষে টেস্ট , ওয়ানডে আর টি-টুয়েন্টি সিরিজে ভাল খেলে তিন ফরম্যাটেই সমতা নিয়ে দেশে ফিরে আসা। তারপর ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার সাথে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ ১-১'এ ড্র করে প্রশংসার সাগরে ভাসা।
সেই দলটিই এবার এবার দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়ে চরম পর্যুদস্ত। পুরো সফরে দু একটি বিচ্ছিন্ন পারফরম্যান্স বাদ দিলে টেস্ট এবং ওয়ানডে সিরিজে কেমন যেন ছন্নছাড়া এক দল মনে হয়েছে। দলগত পারফরম্যান্স ছিল যাচ্ছেতাই। ব্যাটিং শ্রী-হীন, বোলিং নির্বিষ-ধারহীন।
এ সিরিজ দেখে বার বার নিউজিল্যান্ড সিরিজের কথাই মনে হয়েছে। গত বছর ডিসেম্বর আর এ বছর জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ড সফরেও দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ২-০ , তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ৩-০ আর দুই ম্যাচের টি টুয়েন্টি সিরিজে ২-০'তে হোয়াইটওয়াশ হয়ে ঘরে ফিরেছিল টাইগাররা। এবারের মতই প্রাপ্তির খাতা শুন্য থাকলেও ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স , কৃতিত্ব আর অর্জনের আলোকে নিউজিল্যান্ড সফর ছিল তুলনামূলক ভালো। কারণ, ঐ সফরে কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স মাঠ আলোকিত করেছিল।
Advertisement
প্রচন্ড ঠান্ডা , কনকনে আবার কখনো দমকা বাতাসে কঠিন সীমিং কন্ডিশনেও ওয়েলিংটন টেস্টে সাকিব আল হাসান আর মুশফিকুর রহিম অসাধারণ ব্যাটিং করেন। ট্রেন্ট বোল্ট আর টীম সাউদির প্রচন্ড গতি, বিষাক্ত সুইংয়ের মুখেও সাকিব আল হাসান ওয়েলিংটনে ডাবল সেঞ্চুরি করেন। মুশফিকও কম যাননি। তাদের দু'জনার ৩৫৯ রানের রেকর্ড পার্টনারশিপে (যে কোন উইকেট জুটিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জুটি) বাংলাদেশ এক ইনিংসে ৫৯৫ রানের বিশাল স্কোর গড়তে পেরেছিল।
এবার তার কিছুই হয়নি। ডাবল সেঞ্চুরি আর ১৫৯ রানের ইনিংস বহদূরে, সেঞ্চুরি করাও সম্ভব হয়নি। এক কথায় টেস্টে বিনা যুদ্ধে অসহায় আত্মসমর্পন করেছে মুশফিকের দল। আর ওয়ানডেতে প্রথম ম্যাচে মুশফিকুর রহিমের সেঞ্চুরি বাদ দিলে পুরো দলই ছিল সুপার ফ্লপ।
অতি বড় ভক্তও মানছেন, গত কয়েক বছরের মধ্যে এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে অনুজ্জ্বল রুপ। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ দল যত খারাপ খেলেছে, ব্যাটিং আর বোলিংকে যত অনুজ্জ্বল আর ধারহীন মনে হয়েছে; আসলেও কি টাইগাররা এতটা খারাপ ? তাদের ব্যাটিং মেধা-সামর্থ্য আর বোলিং কি সত্যিই এত কমজোরি ?
বাংলাদেশের ক্রিকেট বোদ্ধা , কোচ ও বিশ্লেষকদের কেউই মনে করেন না, সত্যিই বাংলাদেশ অত খারাপ দল। কেউ মানতে চান না টাইগারদের ব্যাটিং ও বোলিং সামর্থও অত কম। তাহলে সমস্যা কোথায়? দেশের প্রথম ওয়ানডে অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু আর বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম দক্ষ ও কুশলী প্রশিক্ষক মোহাম্মদ সালাউদ্দীন জাগো নিউজের সাথে আলাপে খুব জোরের সঙ্গেই বলেছেন, যত খারাপ আর অনুজ্জ্বল মনে হয়েছে, আমাদের দল তত খারাপ না। মেধা-সামর্থ্যও অত কম নয়।
Advertisement
তাহলে সমস্যা কোথায় ? গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর দাবি , প্রস্তুতি ও লক্ষ্য আর পরিকল্পনায়ও সমস্যা ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার কন্ডিশন উপযোগী প্রস্তুতি হয়নি দলের। ঐ কন্ডিশন এবং প্রোটিয়া লাইন আপ তাদের শক্তি-সামর্থ্যের কথা ভেবে দল সাজানো এবং গেম প্ল্যানিং হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, অস্ট্রেলিয়ার সাথে হোম সিরিজের পর দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিকূল, অনভ্যস্ত কন্ডিশন আর প্রোটিয়া শক্তিশালি ব্যাটিং-বোলিংয়ের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে যে ধরণের সাজানো গোছানো প্রস্তুতি আর হোমওয়ার্ক প্রয়োজন, তাতে বড় ধরনের ঘাটতি ছিল। তাই ছেলেরা জায়গামত গিয়ে বিপাকে পড়েছে। আর কোচ সালাউদ্দীনের ধারণা, ব্যাটিং-বোলিং দুই বিভাগেই অ্যাপ্লিকেশনে সমস্যা ছিল প্রবল। সামর্থ্যের যথাযথ ও সময়োপযোগী প্রয়োগ ঘটেনি। তাই দলকে এত ভঙ্গুর মনে হয়েছে। এর বাইরে আরও একটা কথা উঠেছে। তা হলো কন্ডিশন। অনেকেই বলছেন, কন্ডিশনেই মার খেয়েছে বাংলাদেশ। টেস্ট আর ওয়ানডে সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটের সাথে খাপ খাইয়ে উঠতে পারেনি। ঐ পক্ষর দাবি, ঘরের মাঠে আর এশিয়ান কন্ডিশনে বাংলাদেশ ভালই খেলে। কিন্তু কন্ডিশন ভিন্ন হলেই কেমন যেন চুপসে যায়।
ভিন্নমতও অবশ্য আছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের যদি সত্যিই নিজ মাটি আর দক্ষিণ এশিয়ার স্লো-লো উইকেট ছাড়া আর কোথাও ভাল খেলার সামর্থ্য নাই থাকবে, তাহলে ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেছিল কিভাবে? তারপর ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে কিউইদের হারিয়ে সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল? বাস্তবতা হলো, সেই দলটিই চার মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে প্রোটিয়াদের কাছে খাবি খেল। তিন খেলায় বোলাররা সাকুল্যে উইকেট পেয়েছেন ৪ + ৫ = ৯টি। আর ব্যাটসম্যানরা মিলে দলকে এনে দিয়েছেন ২৭৮ , ২৪৯ ও ১৬৯ রান। পুরো সিরিজে কোন সেঞ্চুরি নেই। মুশফিক দু'বার আর সাকিব একবার করে পঞ্চাশের ঘরে পা রেখেছেন। রুবেল ছাড়া আর কোন বোলার এক ম্যাচে তিন উইকেটও পাননি।
অথচ এই উইকেটেই হাশিম আমলা, কুইন্টন ডি কক, ফাফ ডু প্লেসিস আর এ বি ডি ভিলিয়ার্সরা রানের নহর বইয়েছেন। তাদের চার ও ছক্কার ফুলঝুরিতে মাঠ সয়লাব। কে বলবে, এই দলটিই ২০১৫ সালের জুলাইতে বাংলাদেশে গিয়ে এক ম্যাচে ২০০ রানও করতে পারেনি। এক ম্যাচ জিতলেও বাকি দুই খেলায় হেরেছে ( ৭ ও ৯ উইকেটে) চরমভাবে!
সেই সিরিজে বোলিং, ব্যাটিং-দুই বিভাগেই টাইগারদের প্রাধান্য ছিল একচেটিয়া। এবার তারাই অনুজ্জ্বল। দেখে মনে হয়েছে ভীষণ দূর্বল। সেটা যে শুধুই সামর্থ্যে পিছিয়ে থাকার কারণেই হয়েছে, তা নয়। শুধু সামর্থ্যে পিছিয়ে থাকলে কি আর ঘরের মাঠে এই দলটিকেই সিরিজ হারানো যেত ?
এমন নয় দুই বছর আগে বাংলাদেশে দূর্বল ও কমজোরি দল নিয়ে এসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। পুরোদস্তুর দলই ছিল। বরং বোলিংটা এবারের চেয়ে ধারালোই ছিল। ব্যাটিংয়েও সবাই ছিলেন। কিন্তু তারাই মোস্তাফিজুর রহমান, সাকিব আল হাসানদের খেলতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছেন।
বাংলাদেশের এবারের পারফম্যান্স দেখে স্বভাবতই সমর্থক ও ভক্তরা চরম হতাশ। সমালোচকরাও নড়ে চড়ে বসেছেন আর তির্যক মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশ এখনো বাইরে গিয়ে পারে না। যত জারি জুরি দেশের মাটিতেই।
তবে যারা এমন তির্যক কথার তীর ছুড়ছেন, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন; দক্ষিন আফ্রিকাও কিন্তু বাংলাদেশের কাছে চরম পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে গিয়েছিল। এবার তারা নিজেদের মাটিতে প্রতিশোধ নিলো। তার মানে কন্ডিশন একটা বড় কারণ। পারফরমেন্সের ওঠা নামায় কন্ডিশনই মূল।
এআরবি/এমএমআর/এমএস