বিশেষ প্রতিবেদন

আত্তীকরণ শিক্ষকরা ক্যাডার না নন-ক্যাডার?

জাতীয়করণ করা বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে আত্তীকরণ করে আসছে সরকার। ২০০০ সালে তৈরি করা আত্তীকরণ বিধিমালা অনুসরণ করে বেসরকারি শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্ত করা হচ্ছে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকরা।

Advertisement

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা বলছেন, কোনোভাবেই জাতীয়করণকৃত শিক্ষকদের ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত তারা মেনে নেবেন না। আত্তীকরণ করা শিক্ষকরা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হলে ‘চেইন অব সিনিয়রিটি’ লঙ্ঘন হবে। ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এ কারণে তারা আত্তীকরণ করা শিক্ষকদের ‘নন-ক্যাডার’ ঘোষণার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চাপ দিয়ে আসছেন।

অন্যদিকে সরকারীকরণ করা কলেজ শিক্ষক সমিতির নেতাদের দাবি, আগের মতোই আত্তীকৃত শিক্ষকদের ‘ক্যাডার’ ঘোষণা করা হোক।

দুই সংগঠনের এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে আট মাস আগে অর্থ মন্ত্রণালয় ২৮৪টি কলেজ জাতীয়করণের জন্য অর্থছাড়ের সম্মতি দিলেও সংগঠন দুটির দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়করণের সরকারি নির্দেশ (জিও) জারি আটকে গেছে।   এতে অনেক শিক্ষক সরকারি সুবিধা না পেয়ে অবসরে চলে যাচ্ছেন।

Advertisement

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, বিসিএস সাধারণ শিক্ষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এমন কোনো সিদ্ধান্ত আমরা নিতে চাই না। আবার আত্তীকরণ শিক্ষকরা বঞ্চিত হবেন, সেটিও আমাদের কাম্য নয়। আমরা উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করছি।

মন্ত্রী বলেন, বিসিএস শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার এ বিষয়ে আলোচনায় বসেছি। সবার সম্মতিতে জাতীয়করণ শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্ত করা হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সিদ্ধান্ত হওয়ার পর জাতীয়করণ করা শিক্ষকদের জন্য নতুন নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়ন করা হতে পারে।

এদিকে জাতীয়করণ করা কলেজ শিক্ষকদের বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে আত্তীকরণ করা হলে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি। সংগঠনের নেতারা গত ১৩ অক্টোবর সভা করে ১৬ নভেম্বরের মধ্যে জাতীয়করণ করা কলেজ শিক্ষকদের নন-ক্যাডার ঘোষণা করে বিধি জারির আলটিমেটাম দিয়েছেন। অন্যথায় ১৭ নভেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ করে লাগাতার কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করারও হুঁশিয়ারি দেন তারা।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল রোববার (২২ অক্টোবর) সব জেলায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি। এছাড়া ১১ নভেম্বর ১০টি সাংগঠনিক বিভাগে এবং ১২ নভেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন সংগঠানের নেতারা।

Advertisement

বিগত সময়ে জাতীয়করণ করা বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে আত্তীকরণ করে আসছে সরকার। ২০০০ সালে তৈরি করা আত্তীকরণ বিধিমালা অনুসরণ করে শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্তিতে আপত্তি করেনি সমিতির নেতারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, সরকারি কলেজবিহীন উপজেলায় একটি করে কলেজ জাতীয়করণ করা হবে। ওই ঘোষণার পরই বিরোধিতা করে আসছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আই কে সেলিমুল্লাহ খন্দকার বলেন, আমরা কোনোভাবেই জাতীয়করণ করা শিক্ষকদের ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত মেনে নেব না। আত্তীকরণ করা শিক্ষকরা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হলে আমাদের চেইন অব সিনিয়রিটি লঙ্ঘন হবে। আমাদের ক্যাডারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।

তিনি আরও বলেন, ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হতে হলে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এজন্য দীর্ঘ সময় নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে হয়। অথচ কলেজ জাতীয়করণ করা হলেই সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা আমাদের ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হবেন, এটি কেমন সিদ্ধান্ত?

‘আত্তীকৃতদের নন-ক্যাডারে রেখে সরকার তাদের সুবিধা বাড়িয়ে দিতে পারে’- এমন পরামর্শ দিয়ে তিনি সরকারি কলেজে আত্তীকরণ শিক্ষকদের বদলির সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানান। অন্যথায় কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।

এদিকে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, জাতীয়করণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিপ্রাপ্ত কলেজগুলো মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সরেজমিনে স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ, শিক্ষক-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত তথ্যসহ আনুষঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অর্থছাড়ের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে সেটি পাঠায়। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২৮৪টি কলেজ জাতীয়করণের জন্য অর্থছাড়ের সম্মতি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর এসব কলেজের সব সম্পত্তি সরকারকে ডিট অব গিফট (দানপত্র) দলিল সম্পন্ন করে মন্ত্রণালয় পাঠায়।

সরকারীকরণ করা কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি জহিরুল ইসলাম বলেন, ১৯৭৮ সাল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হয়ে আসছে। তখন থেকেই কলেজ শিক্ষকরা ক্যাডার মর্যাদা পেয়ে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য একটি উপহার দেয়ার পরে হঠাৎ করে বিসিএস শিক্ষক সমিতি ‘নো বিসিএস, নো ক্যাডার’ আন্দোলন শুরু করেন। তাদের এ দাবি অনৈতিক। আমরা বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলেও বহু বছর ধরে চাকরি করে আসছি। আমাদের চাকরি আত্তীকরণ হলে সার্ভিস অর্ধেক ধরা হয়। তিনি আরও বলেন, একই প্রতিষ্ঠানে একই কাজ করা শিক্ষকরা ক্যাডার-নন-ক্যাডার থাকলে শ্রেণিবৈষম্য তৈরি হবে। শিক্ষকদের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। ১৯৮১, ১৯৯৮ ও ২০০০ সালের বিধিমালা অনুযায়ী, আত্তীকৃত শিক্ষকরা ক্যাডার মর্যাদা পেয়ে আসছেন। শিক্ষকদের আরও সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য এ বিধিমালা সংশোধন করতে হবে। কোনোভাবেই নন-ক্যাডার ঘোষণা করা যাবে না।   দুই সংগঠনের পাল্টাপাল্টি এমন অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়করণ করা কলেজ শিক্ষকরা ‘ক্যাডার’ না ‘নন-ক্যাডার’ হবেন সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যে কারণে সব কার্যক্রম শেষ হলেও জাতীয়করণের জিও আটকে আছে। আট মাস পেরিয়ে গেলেও জিও জারি না হওয়ায় এসব কলেজ শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। অনেক শিক্ষক অবসরে চলে যাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন। তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় প্রতি অর্থবছর ১০০ কলেজ জাতীয়করণের জন্য মতামত দিয়েছে। আমরা চাচ্ছি একত্রে সবগুলো কলেজ জাতীয়করণ করতে। তিন ধাপে জাতীয়করণ হলে অসম প্রতিযোগিতা দেখা দেবে। দুর্নীতির আশঙ্কাও রয়েছে। এ সঙ্কট থেকে উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর মতামত চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ক্যাডার-নন-ক্যাডার ঘোষণা নিয়ে যেসব কথা শোনা যাচ্ছে এসব গুজব। আমাদের কাজ হলো প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা। আমরা সে কাজটি প্রায় শেষ করে এনেছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেলেই বাকি কাজ শেষ করে জিও জারি করা হবে।

প্রসঙ্গত, সরকারি স্কুল ও কলেজবিহীন উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কয়েক দফায় এসব কলেজ জাতীয়করণে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। দেশে বর্তমানে ৩৩৫টি সরকারি কলেজ রয়েছে। ৩১৫টি উপজেলায় কোনো সরকারি কলেজ নেই। ইতোমধ্যে ২৪টি উপজেলার কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে।

এমএইচএম/এমএআর/জেআইএম