পবিত্র কুরআনুল কারীমের আলোচ্য বিষয় কী? কুরআনুল কারীম কার জন্য নাযিল হয়েছে? কুরআন নাযিলে কেন রমজান মাসকে বেছে নেয়া হল? এ সবরে একটাই উত্তর আর তা হচ্ছে, মানুষ, মানবতা ও মানবতার মুক্তি। সৃষ্টির সব কিছুই অস্তিত্ব লাভ করেছে মানুষ ও মানবতার কল্যাণে; সৃষ্টির সব কিছুকে সৌন্দয্যমণ্ডিত করেছে মানুষ। মানুষের প্রয়োজনে, মানুষের কল্যাণে নাযিল হয়েছে আল-কুরআন। তাইতো আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাত কুরআন নাযিলের মাস হিসেবে বেছে নিয়েছেন রমজান মাসকে। আল্লাহ তাআলা বান্দাগণের কল্যাণে রমজান মাসকে তিনটি দশকে ভাগ করেছেন; রহমত, মাগফেরাত, জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতির দশক হিসেবে। বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশা লুকায়িত আছে এই মহা গ্রন্থ আল কুরআনে। যার মধ্যে নিহিত আছে সমগ্র ইনসানিয়াতের মুক্তির কলা কৌশল। একজন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কী প্রয়োজন। তারপরই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব ও মহাবিশ্ব পরিচালনায় কি চাই? সব ফলাফলই রয়েছে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে। এই কুরআনের মর্মভেদ বুঝার একমাত্র মোক্ষম সময় হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস।ইসলাম বিরোধীদের মর্মার্থ অনুধাবনএই কুরআনই হচ্ছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াস সাল্লামের সবচেয়ে বড় মোজেজা। এই কুরআনের মর্ম উপলব্দি করেই ইসলামে সবচেয়ে বড় দুশমন ইসলামের সবচেয়ে বড় সিপাহসালারে পরিণত হয়েছেন। তিনি আর কেউ নন; তিনি হচ্ছে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু। এই কুরআনের তেলাওয়াত শ্রবন করার জন্যইতো রাতের আঁধারে মুশরিক, কুরাইশ নেতারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াস সাল্লামের ঘরের আশে-পাশে এসে গোপনে তেলাওয়াত শুনে মজা পেত, আনন্দ পেত, প্রশান্তি লাভ করত; আর দিনের বেলায় নেতৃত্বের লোভে বিরোধীতা করত। তারাও কুরআনের মর্ম উপলব্দি করতো; কিন্তু মক্কার নেতৃত্বের জন্য প্রকাশ করত না। যার অন্যতম হচ্ছে- আবু জেহেল, আবু সুফিয়ান।লক্ষণীয় বিষয়মুসলমানের জন্য নাযিলকৃত কুরআনের মর্মার্থ উপলব্দি করেই বর্তমান জামানার অমুসলিম বিজ্ঞানীরা আকাশ, মহাকাশ, বিশ্ব, মহাবিশ্ব, স্যাটেলাইট তথা বিজ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করছে; আর এসবের সিংহভাগের দাবিদার, অমুসলিমরাই। পিছিয়ে আছে শুধু তারাই যাদের জন্য নাযিল হয়েছে এই মহাগ্রন্থ। সুতরাং আজ আমাদের উচিত কুরআনকে উপলব্দি করে কুরআন অনুযায়ী সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে আগামীর দিনগুলোকে ইসলামের রঙে সাজানোর। দেখার অপেক্ষায় কল্যাণময় এক নতুন পৃথিবীর। যে পৃথিবীতে থাকবে না মানবতার কোনো হাহাকার। বিরাজ করবে না অশান্তির দাবানল। বইবে শান্তির সুবাতাস। এ সবের জন্য প্রয়োজন দেহ ও মনের একনিষ্ঠ অধ্যাবসায় ও কুরআনের অধ্যয়ন। যা সম্ভব শান্তির মাস পবিত্র রমজানুল মোবারকেই। তাই যখন রমজান আসে তখন আমরা এই মাসকে অন্যরকম মর্যাদায় ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে পালন করতে চেষ্টা করা। এই উপলব্দি মনে করা যে, এই বুঝি আল্লাহর পক্ষ থেকে সরাসরি আসমান থেকে আমাদের জন্য রহমত ও বরকতের ফলগুধারা নাযিল করছেন। আর এমনই প্রশান্তিমূলক ভাব আমাদের মাঝে প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্টি হয়। এ মাসে আপনি যতই কুরআন তেলাওয়াত করেন ততই ভাল লাগে। মনে হচ্ছে যেন আপনার মহাকালের অভুক্ত হৃদয় তৃপ্ত হচ্ছে কুরআনে তেলাওয়াতে। আর যদি কুরআন অর্থ বুঝে অধ্যয়ন শুরু করা হয়। মনে হবে রহমতের অজানা সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিধারার মতো ঝরছে আল্লাহর অফুরন্ত রহমত আর কল্যাণ। যা অন্য কোনো মাসে উপলব্ধি করা যায় না। সারাদিন উপবাস করেও কোনো মুসলিমের মাঝে ক্লান্তির চিহ্ন মাত্র প্রতীয়মান হয় না। মনে হয় নিশ্চিন্ত, আনন্দচিত্ত, প্রস্ফুটিত আভা এই বুঝি অফুরন্ত শীতলতায় বয়ে চলেছে মুমিন বান্দার জীবন। প্রশান্তি লাভ করছে স্বর্গীয় প্রশান্তি।এর কারণগুলো কী?ক. পৃথিবীতে প্রত্যেকটি বস্তুর স্মরণ ও কর্ম আলোচনা হয় প্রতিষ্ঠবার্ষিকীতে। কুরআনে ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম নয়; তাইতো আল-কুরআনের মর্ম উপলব্দি করতে হবে তার নাযিলের মাসে। আলাহ বলেন- শাহরু রামাদানাল্লাজি উনযিলা ফিহিল কুরআন (সুরা বাক্বারা : আয়াত ১৮৫)। অর্থাৎ রমজান মাস; এ মাসেই কুরআন নাযিল হয়েছে। সুতরাং এর মর্ম উপলব্দির, আলোচনার, শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত মাস হচ্ছে পুরো রমজান মাস।খ. এ মাসেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার সৃষ্টির সর্বোত্তম প্রশান্তি লক্ষ্যে জান্নাতের সকল দরজাসমূহকে উন্মুক্ত করে দেন; পক্ষান্তরে তার সৃষ্টিকে অশান্তির দাবানল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে জাহান্নামের দরজা সমূহকে রুদ্ধ করে দেন; বিশেষ করে ইনসানিয়াতকে কালিমামুক্ত করতে; ধোকা, প্রতারণা ও প্রবঞ্চনামুক্ত করতে শয়তান ও দুষ্ট জিনদের শিকলাবদ্ধ করে রাখ হয়। মানুষ যাতে আল-কুরআনের মর্ম উপলব্দি করতে কোনো প্রকার অসুবিধা না হয়; ইবাদত-বন্দেগী করতে হয়রানি-পেরেশানির শিকার না হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াস সাল্লাম বলেন, “ইজা যাআ রামাদানু ফুতিহাত আবওয়াবুল জান্নাতি ওয়া গুলিক্বাত আবওয়াবুন্নারি ওয়া চুফ্ফিদাতিশ শায়াত্বীনু”। অর্থাৎ রমজান মাস এলে জান্নাতের দরজা সমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়; জাহান্নামের দ্বার সমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের শৃংখলিত করা হয়। (বুখারি ও মুসলিম)। এর একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে- মানুষ যেন আল-কুরআনের মর্ম উপলব্দি করে সঠিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন না হয়।গ. রমজান মাসেই জিব্রিল আলাইহিস সাল্লাম কুরআন কারীম পড়ে শুনাতেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াস সাল্লামও তার সাথে কুরআন পড়তেন এবং এর মর্ম উপলব্দি করতেন। সে আলোকে সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে বাস্তবতায় রূপ দিতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াস সাল্লামের সীরাত, পথ অনুসরণ করে প্রত্যেক মুমিনের উচিত বেশি বেশি পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করা এবং এর মর্মার্থ উপলব্দি করা। ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “কানা জিব্রিলু ইয়ালক্বাহু ফি কুলি লাইলাতিন মিন রামাদানা ফা ইউদারিসুহুল কুরআনা”। (বুখারি) জিব্রিল আমিন রমজানের প্রতি রাতে এসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াস সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁকে নিয়ে কুরআন পাঠ করতেন। ঘ. পবত্রি কুরআনের মর্মার্থ উপলব্ধির জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াস সাল্লাম আদিষ্ট হয়েছে; বর্ণনায় এসেছে- যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং সে অনুযায়ী আমল করে তার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, সে দুনিয়াতে ভ্রষ্ট হবে না এবং আখিরাতে দুর্ভাগা-হতভাগাদের অন্তর্ভুক্ত হবে না। আল্লাহ বলেন-“ফা ইম্মা ইয়াতিয়্যান্নাকুম মিন্নি হুদান ফামানিত্তাবিআ’ হুদায়া ফা লা ইউদিলু ওয়া লা ইয়াশ্ক্বা” (সুরা ত্বাহা : আয়াত ১২৩) অর্থাৎ সুতরাং যে আমার দেয়া হিদায়াতের অনুসরণ করবে, সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং দুঃখ কষ্টে পতিত হবে না।তাইতো আমাদের আক্বাবেরগণ তথা ইসলামের খলিফাগণ সদা সর্বদা কুরআনের মর্ম বুঝে কুরআন অধ্যয়ন করতেন এবং সেমতে জীবন, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সারা বিশ্ব পরিচালনা করতেন। যার প্রমাণ খোলাফায়ে রাশেদা। হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু রমজানে প্রতিদিন কুরআন তিলাওয়াত খতম করতেন; কেউ কেউ নামাজে এবং নামাজের বাইরে (কিয়ামুস সিয়ামে) তিন দিনে কুরআন খতম করতেন; কেউ কেউ সাত দিনে; কেউ কেউ দশ দিনে এই কুরআন খতম করে কুরআনের মর্ম উপলব্দি করতেন। প্রখ্যাত আলেম ইসলামের ধারক ইমাম যুহরি রমজান মাস আসলেই হাদীস পাঠ ও ইলমের মজলিস ত্যাগ করে কুরআন অধ্যয়নে লেগে যেতেন।খেয়াল রাখতে হবে যে, কুরআনুল কারীম শুধু খতম করার জন্যই নাযিল হয়নি। তাই কোনো রূপ অর্থ না বুঝে; চিন্তাভাবনা না করে; অন্তরে আল্লাহর ভয় ও মহব্বত সৃষ্টি না করে কুরআনের আবৃত্তি আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া ঠিক নয়। কেননা আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেন। “কিতাবুন আনযালনাহু ইলাইকা মুবারাকুল্লিয়াদ্দাব্বারু আয়াতিহি ওয়া লিয়া তাজাক্কারা উলুল আলবাবি” (সুরা সোয়াদ : আয়াত ২৯) অর্থাৎ এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে।সুতরাং বোঝা গেল- আল-কুরআনের মর্মার্থ অনুধাবনের উপযুক্ত সময় ও মাস হচ্ছে রহমত বরকত কল্যাণের মাস পবিত্র রমজান মাস। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে কুরআনের মর্মার্থ উপলব্দি করার, মানবতার সকল পর্যায়ে আল-কুরআনের বাস্তব শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠা করার তথা নিরলস কাজ করে যাওয়ার তাওফিক দান করুন আমীন।তথ্যসূত্র : কুরআনুল কারীম, সহিহ বুখারি, মুসলিম।জাগো নিউজ ২৪ ডটকমের সঙ্গে থাকুন। রমজান সম্পর্কিত সুন্দর সুন্দর ইসলামী আলোচনা পড়ুন। কুরআন-হাদীস মোতাবেক আমলী জিন্দেগী যাপন করে রমজানের রহমত, বরকত ও মাগফেরাত অর্জন করুন। আমীন, ছুম্মা আমীনএইচএন/পিআর
Advertisement