ফিচার

জীবনানন্দ দাশ : আমাদের শুদ্ধতম কবি

ঘটনাটি ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবরের। কলকাতার বালিগঞ্জের পথ ধরে আনমনে হেঁটে চলেছেন বরিশালের গ্রাম্য প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা এক অসাধারণ কবি। অজানা তাঁর গন্তব্য। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলা সেই কবি সেদিন বেশিদূর আর এগোতে পারেননি। তাঁর পথ রুদ্ধ করেছিলো এক ঘাতক ট্রাম। সেদিন ট্রামের নিচে পড়ে মুহূর্তেই এলোমেলো হয়ে যায় প্রকৃতির আশ্চর্য বিস্ময় জাগানো এ কবির জীবন ঘড়ি। ঘটনার আট দিন পর ২২ অক্টোবর কলকাতার শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে জীবনমঞ্চ ত্যাগ করেন ‘নাটোরের বনলতা সেন’র স্রষ্টা, আমাদের শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দের ৬৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে লিখেছেন ইব্রাহীম খলিল-

Advertisement

প্রচারবিমুখ মানুষটি অসংখ্য কবিতা লিখে গেছেন পৃথিবীর পথে পথে জন্ম নেওয়া নানা ধরনের পাঠকের জন্য। তেমনই এক পাঠক ছিলেন চিকিৎসক কবি ও জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ। কবির শেষ সময়ে হাসপাতালে তার সার্বক্ষণিক দেখভালের দায়িত্বে থাকা ভূমেন্দ্র গুহ জীবনানন্দের রেখে যাওয়া সাহিত্য ও জীবন কর্ম নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বলেছিলেন, গত একশতকে ট্রামের নিচে চাপা পড়ে দুর্ঘটনায় মাত্র একজন মানুষই মারা যায়, তিনি হলেন জীবনানন্দ দাশ।

নিভৃতচারী, চুপচাপ নিঃসঙ্গ এই মানুষটি বেঁচে থাকতে খ্যাতির চেয়ে বেশি সয়েছেন অবহেলা, বিদ্রুপ। কেউ কেউ তাকে নিয়ে নিয়মিত বিদ্রুপ করে লিখে যেতো বিভিন্ন কাগজে। তবে মৃত্যুর পর জীবনানন্দ দাশের নাম যশ খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মৃত্যুর পর নতুন নতুন অপ্রকাশিত লেখা আবিষ্কার হতে থাকে। বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃৎদের মধ্যে তার নামটিই চলে আসে সবার আগে।

জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্ম সমাজের মুখপত্র ‘ব্রাহ্মবাদী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন। আর মা কুসুম কুমারী দাশ গৃহিণী। তবে তিনিও নিয়মিত লেখালেখি করতেন। জীবনানন্দ ছিলেন বাবা-মার জ্যেষ্ঠ সন্তান; ডাকনাম ছিল মিলু। তার ভাই অশোকানন্দ দাশ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে এবং বোন সুচরিতা দাশ ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কম বয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার বিরোধী ছিলেন বলে বাড়িতে মায়ের কাছেই মিলুর বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত।

Advertisement

কবির স্কুল জীবন শুরু হয় বরিশাল শহরের ব্রজমোহন স্কুলের (বিএম স্কুল) মাধ্যমে। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে আট বছরের মিলুকে বিএম স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে বিএম স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি) পরীক্ষায় পাস করেন। এরপর ভর্তি হন বিএম কলেজে। দু’বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন প্রথম বিভাগে। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

বরিশাল শহরের প্রাণ প্রকৃতি আর সাহিত্যমনা পরিবারে জন্ম নেওয়া জীবনানন্দ দাশের দেখার দৃষ্টি তৈরি করে দেয় ভিন্ন রূপে। জীবন ও প্রকৃতির মাঝে জীবনানন্দ খুঁজে বের করতেন ভিন্ন স্বাদ। মায়ের অনুপ্রেরণায় জীবনানন্দ দাশ কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৯১৯ সালে ব্রাহ্মবাদী পত্রিকায় ‘বর্ষা আবহন’ নামে একটি কবিতা ছাপা হয়।

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’ প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। এটি ‘কবিতাভবন সংস্করণ’ নামে অভিহিত। সিগনেট প্রেস বনলতা সেন প্রকাশ করে ১৯৫২ সালে। বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের কবিতাসহ পরবর্তী কবিতাগ্রন্থ ‘মহাপৃথিবী’ ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দের জীবদ্দশায় সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮)’। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর কিছু আগে প্রকাশিত হয় ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’।

কবির মৃত্যু-পরবর্তী প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ হলো- ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত ‘রূপসী বাংলা’ এবং ১৯৬১ সালে প্রকাশিত ‘বেলা অবেলা কালবেলা’। তাঁর অগ্রন্থিত কবিতাবলী নিয়ে প্রকাশিত কবিতা সংকলনগুলো হলো- সুদর্শনা (১৯৭৩), আলো পৃথিবী (১৯৮১), মনোবিহঙ্গম, হে প্রেম তোমার কথা ভেবে (১৯৯৮), অপ্রকাশিত একান্ন (১৯৯৯) এবং আবছায়া (২০০৪)। তিনি কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। ২১টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন। তবে এর একটিও তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি।

Advertisement

মৃত্যুর পরও জীবনানন্দ দাশ যেন এতটুকু পুরনো হননি। তাঁর কবিতা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আজও দিয়ে চলেছে পাঠকের মনের খোরাক। কবিতার মাধ্যমে মহাত্মা হয়েছেন ‘মহাত্মা’র এ স্রষ্টা। বেঁচে থাকতে কোন মূল্যায়ন না পেলেও কবির যেন এতটুকু ক্ষোভ ছিল না। তিনি জানতেন, ঠিক একদিন মানুষের দ্বারাই তিনি পূজিত হবেন। কিন্তু হায়, সেদিন তাঁর সেই পূজা গ্রহণ করার কোন সামর্থ থাকবে না। তিনি পৃথিবীতে এসেছেন, আবার চলেও যাবেন। এটাই সত্য, এটাই চিরন্তন। তাই কবিকে হারানোর বেদনায় কেবলই তাঁর মহাত্মা কবিতাটি মনের অজান্তে আবৃতি করে চলি-‘আলোর মতন ব্যাপ্ত অন্তরাত্মা নিয়েবিশ্বের অগ্নির উৎস থেকেমাঝে মাঝে একজন অবিস্মরণীয়কল্যাণকৃতের জন্ম হয়;অমর সে নয়– কোনো অন্তহীন অমেয় সময়তার হাতে নেই, –তবুও মৃত্যু এসে চোখেচুম্বন দেবার আগে সবচেয়ে সাত্ত্বিক আলোকেআমাদের এই অন্ধ ক্লান্ত শতাব্দীকেস্নিগ্ধ করে চলে গেছে সেই যুবা প্রৌঢ় ও স্থবির;বলেছে মানুষ সত্য, তবু সত্য মানুষের চেয়েও গভীর।’

এসইউ/এমএস