খেলাধুলা

কেন ব্যাটিংয়ে এই দুর্দশা

বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ঘরের মাঠে সাম্প্রতিক সময় ও নিকট অতীতে বেশ ভাল খেলেছেন। এই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেই দুই বছর আগে সৌম্য সরকার ঝড়ো ব্যাটিং করে দুই ম্যাচে জয়ের রূপকার হবার পাশাপাশি সিরিজ সেরা হয়েছেন। তামিম-সাকিবরা চার ছক্কার ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন।

Advertisement

কিন্তু এবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে মুশফিক ছাড়া আর কারো ব্যাট কথা বলছে না। সবাই যেন রান করতে ভুলে গেছেন! সৌম্য বারবার অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলে খোঁচা দিতে গিয়ে উইকেটের পিছনে ক্যাচ দিয়ে ফেরত এসেছেন।

ইমরুল দুইবার লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া ডেলিভারিকে অযথা ব্যাটে আনতে গিয়ে কিপারের হাতে ক্যাচ তুলে বিদায় নিয়েছেন। সাকিবের মত বড় মাপের ব্যাটসম্যান ওয়ানডে সিরিজে পরপর দুই ম্যাচে ইমরান তাহিরের ‘গুগলিতে’ ধরা খেলেন।

এগুলো কি সামর্থ্যে ঘাটতি? নাকি বিচ্ছিন্ন সমস্যা? এসব সমস্যা ও ঘাটতি-দূর্বলতা কেন? জাগো নিউজের সাথে একান্ত আলাপে গাজী আশরাফ হোসেন লিপু চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কেন দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে নিজেদের সঠিকভাবে মেলে ধরতে পারছেন না- লিপু তার সম্ভাব্য কারণ খুঁজে বের করেছেন।

Advertisement

কারো কারো ধারণা, অস্ট্রেলিয়ার সাথে হোম সিরিজ ও টেস্ট জয়, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের সর্বোত্তম মানসিক ও ক্রিকেটীয় প্রস্তুতি। লিপু কিছুতেই তা মনে করেন না। তার কথা, ‘ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় গেছে বাংলাদেশ; কিন্তু সেটা কিছুতেই প্রোটিয়াদের মাটিতে তাদের সাথে খেলার প্রস্তুতি হতে পারে না। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, আমরা দেশে খেলেছি স্লো ও লো পিচে। যার সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার কন্ডিশনের কোনই মিল নেই।’

বাংলাদেশে ছিল স্পিনারদের দাপট। দক্ষিণ আফ্রিকায় পেস কন্ডিশন। সেটাই জানালেন লিপু। তিনি বলেন, ‘ঢাকার শেরেবাংলা ও চট্টগ্রামের পিচে প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ ওভারের বড় অংশ মানে ৫৫-৬০ ওভারের মত স্পিনাররাই বল করেছে। সেটা আমাদের ক্ষেত্রেও হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ারও হয়েছে। আমাদের ব্যাটসম্যানদের হয়ত সারা দিনে ১২-১৪ ওভারের মত অজি ফাস্ট বোলার কামিন্সের বল খেলতে হয়েছে। বাকি সময় তো স্পিনাররাই বল করেছে।’

দক্ষিণ আফ্রিকায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। সেটাই বোঝালেন গাজী আশরাফ লিপু। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি তো আর দক্ষিণ আফ্রিকায় হয়নি। বরং উল্টোটা হচ্ছে। পেসারদেরই খেলতে হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ সময়। কাজেই আমি বলবো অস্ট্রেলিয়ার সাথে হোম সিরিজ এবং দক্ষিণ আফ্রিকা খেলতে যাওয়ার আগে আমাদের প্রস্তুতি ছিল ‘শূন্য’। কন্ডিশন ও দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটিং লাইন ও বোলিং আক্রমণকে বিবেচনায় আনলে আমারা ‘জিরো’ প্রস্তুতি নিয়ে সেখানে গেছি।’

প্রোটিয়ারাও যে বাংলাদেশকে নিয়ে হোমওয়ার্ক করবে, সেটা মাথায় আনেনি টিম ম্যানেজমেন্ট। সেটাই জানালেন লিপু। তিনি বলেন, ‘আমরা হয়ত মাথায়ই আনিনি, আমাদের নিয়ে শতভাগ পেশাদার প্রোটিয়ারা অনেক হোমওয়ার্ক করবে। সাধারণতঃ উপমহাদেশের দলগুলোর বিপক্ষে তারা কিছু ফর্মুলা ফলো করে। যেমন, এ অঞ্চলের ব্যাটসম্যানরা অন দ্য রাইজ খেলতে ভালবাসে আর সামনের পায়ে খেলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সে সব জায়গায় কম বল করা এবং করলেও অনেক কম করা। এছাড়া তারা উপমহাদেশের ব্যাটসম্যানদের শর্ট পিচে বিভ্রান্ত করে। হুট-হাট বাউন্সার ছুড়বে। শুধু ব্যাটসম্যানকে ভড়কে দেয়ার জন্য। তার মনোযোগ-মনোসংযোগে খানিক চিড় ধরাতে, তাকে বিব্রত আর বিভ্রান্ত করতে। এসব বিষয়ে যথাযথ প্রস্তুতি ছিল কি না, সন্দেহ।’

Advertisement

লিপু আরও বলেন, ‘এমন নয়, সব ব্যাটসম্যানই টেস্টে খাটো লেন্থের শরীর সোজা বলে আউট হয়েছে। ক্রমাগত বাউন্সার আসতে থাকলে একটা ভয়, দ্বিধা-সংকোচ চলে আসে। ব্যাটিংয়ের যে স্বাভাবিক ধারা ও সাবলীলতা তা খানিক বাধাগ্রস্থ হয়। আর তাতেই স্বাভাবিক ব্যাটিং শৈলী উপহার দেয়া কঠিন হয়। এগুলো হচ্ছে- ওইসব কন্ডিশনে খেলার বড় অন্তরায়। সাধারণতঃ যে অন্তরায়গুলো আমরা ঘরের মাঠে কিংবা উপমহাদেশীয় কন্ডিশনে মুখোমুখি হই না। আমাদের দেশের উইকেটে কোন ব্যাটসম্যান ৩০/৪০ করার পর অমন নেতিবাচক ও কঠিন পরিস্থিাতির মুখে পড়ে না।’

লিপু অভিযোগের সুরে বলেন, ‘আমরা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ খেলার পর প্রায় অল্প কদিনের নোটিশেই চলে গেলাম দক্ষিণ আফ্রিকায়। দেখে মনে হলো আমরা খুব বড় দল হয়ে গেছি। ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলেই ছুটলাম দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে। প্রোটিয়ারা নিজ মাটিতে কতটা শক্তিশালী, তাদের ট্র্যাক রেকর্ড কত সমৃদ্ধ; আমরা মাথায়ই আনলাম না।’

নিজেদের এখনও অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা মানের দলে ভাবার সময় হয়নি বলে মনে করেন লিপু। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমার মনে হয়, আমরা এখনো অত বড় আর ভাল দল হইনি যে, এত শীঘ্রই অমন কঠিন সিরিজ খেলার মানসিক ও ক্রিকেট প্রস্তুতি নিয়ে ফেলতে পেরেছি। অল্প ক'দিনের প্র্যাকটিস পর্যাপ্ত না। যে কোন মূল্যে প্রস্তুতির সময় রাখা উচিৎ ছিল। সেটা অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার দুই সিরিজের মাঝে আরও সময় বাড়ানো একান্তই জরুরি ছিল। অথচ আমরা তা না করে নিজেদের বড় দলগুলোর মত ভেবে চলে গেলাম। গিয়ে প্লেয়ারদের বিপদে ফেললাম। আমরাও নিজেরা গিয়ে পড়লাম বেকায়দায়।’

গাজী আশরাফ হোসেনের মূল্যায়ন, শুধু প্রস্তুতি ভাল না হওয়াই শেষ কথা নয়। যথাযথ হোমওয়ার্ক ও লক্ষ্য এবং পরিকল্পনায়ও ঘাটতি ছিল; চিন্তা ভাবনায় দুরদর্শিতার কমতি ছিল। তাই আফ্রিকার দ্বিতীয় গ্রেডের বোলিংয়ের বিপক্ষেও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের খারাপ মনে হয়েছে।

লিপুর কথা, ‘আমার মনে হয় বেশি দ্রুত গতির বোলিং এবং চেঞ্জ অফ পেসে আমরা সমস্যায় পড়ছি। আমার কাছে মনে হয়েছে কালকের (দ্বিতীয় ওয়ানডে) উইকেটের সাথে আমাদের দেশের উইকেটের অনেক মিল ছিল। সেখানে এবি ডি ভিলিয়ার্স অসাধারণ খেলেছে। আমাদের ব্যাটিংটা আরও ভাল হওয়ার উচিৎ ছিল।’

ফিল্ডিংকে বাজে আখ্যা দিয়ে লিপু বলেন, ‘অন্য সিরিজের তুলনায় ক্যাচ উঠেছে অনেক কম। যাও উঠেছে, সেগুলোও তালুবন্দী হয়নি। সুযোগ তৈরি হয়েছে। ৬০ ভাগ কাজে লাগানো যায়নি।’

এআরবি/আইএইচএস/এমএমআর/আইআই