অর্থনীতি

মূল টাকাই ফেরত পাবেন না বীমাগ্রাহকরা!

জীবন বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা বাড়িয়ে খসড়া প্রবিধানমালা তৈরি করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এ খসড়া প্রবিধানমালা চূড়ান্ত করা হলে বীমাগ্রাহকরা পলিসির মেয়াদ শেষে মূল টাকা ফেরত পাবেন না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

Advertisement

তারা বলছেন, একটি জীবন বীমা কোম্পানির পলিসিগ্রাহকরা কেমন সুবিধা পাবেন তা নির্ভর করে ওই কোম্পানির ইনভেস্টমেন্ট রিটার্নের (বিনিয়োগ আয়) ওপর। আর কোম্পানির ইনভেস্টমেন্ট বা বিনিয়োগ নির্ভর করে কোম্পানির প্রিমিয়াম আয় থেকে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাদ দিয়ে থাকা উদ্বৃত্ত অর্থের ওপর। এক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত অর্থ বাড়লে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে এবং বিনিয়োগ আয়ের পরিমাণও বাড়বে। যার সুফল পাবেন বীমাগ্রাহকরা। কিন্তু ব্যয় বাড়ালে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ কমে যাবে।

বর্তমান আইন অনুযায়ী, ব্যবসায়িক কার্যক্রম ১০ বছর অতিক্রম করা একটি জীবন বীমা কোম্পানি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ৯০ শতাংশ এবং নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করছে। অর্থাৎ প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ১০ শতাংশ এবং নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ৮৫ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করে কোম্পানি লাভসহ বীমাগ্রাহকদের ফেরত দেয়।

এই নিয়মে ব্যবসা পরিচালনা করে বর্তমানে দেশে ব্যবসারত ৩২টি জীবন বীমা কোম্পানির মধ্যে হাতেগোনা তিন-চারটি কোম্পানি গ্রাহকদের কিছুটা মুনাফা দিতে পারছে। বাকি কোম্পানি থেকে গ্রাহকরা কোনো মুনাফা পাচ্ছেন না। এ পরিস্থিতিতে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা যে হারে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে গ্রাহকরা বীমা পলিসি ক্রয় করে ১০, ১৫ বা ২০ বছর ধরে কোম্পানিতে যে টাকা জমা করবেন মেয়াদ শেষে মুনাফা তো দূরের কথা মূল টাকাও ফেরত পাবেন না।

Advertisement

ব্যবস্থাপনা ব্যয়সংক্রান্ত আইডিআরএ’র খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রথম পাঁচ বছর (ব্যবসা শুরুর পর পাঁচ বছর পর্যন্ত) বীমা কোম্পানিগুলো প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ৯৮ শতাংশ ও নবায়ন প্রিমিয়ামের ২৫ শতাংশ ব্যয় করতে পারবে। তবে বর্তমানে বলবৎ ১৯৫৮’র বিধিতে এই ব্যয়ের সীমা নির্ধারিত আছে, প্রথম তিন বছর প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামের সাড়ে ৯৭ শতাংশ এবং নবায়নে সাড়ে ২২ শতাংশ। আর চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ বছরে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামে সাড়ে ৯৬ শতাংশ এবং নবায়নে ২০ শতাংশ।

অর্থাৎ খসড়া প্রবিধান বাস্তবায়িত হলে বীমা কোম্পানিগুলো প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহে বর্তমানের চেয়ে এক দশমিক পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বেশি খরচ করতে পারবে এবং নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ক্ষেত্রে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ব্যবস্থাপনা ব্যয় করতে পারবে।

খসড়া প্রবিধানে ষষ্ঠ থেকে দশম বছরে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামের ৯৭ শতাংশ এবং নবায়নের ২২ শতাংশ খরচের সুযোগ রাখা হয়েছে। অথচ আগের বিধিতে ব্যবসা শুরুর ষষ্ঠ থেকে দশম বছরে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামের ৯৫ শতাংশ এবং নবায়ন প্রিমিয়ামের ১০ শতাংশ খরচের অনুমোদন ছিল। অর্থাৎ খসড়া প্রবিধানে আগের চেয়ে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামে দুই শতাংশ এবং নবায়নে ১২ শতাংশ বেশি খরচের বিধান রাখা হয়েছে।

একইভাবে খসড়া প্রবিধানে বলা হয়েছে, ১০ বছর পর ব্যবসা বলবৎ থাকলে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে এক থেকে ১০০ কোটি টাকার ৯৩ শতাংশ খরচ করতে পারবে বীমা কোম্পানিগুলো। আর ১০১ থেকে ৫০০ কোটি টাকা প্রিমিয়ামের ৯২ শতাংশ এবং ৫০১ থেকে তদূর্ধ্ব টাকার প্রিমিয়ামের ৯১ শতাংশ খরচ করতে পারবে। আর নবায়ন প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কোম্পানির ব্যবসা শুরুর ১০ বছর পর থেকে নবায়ন প্রিমিয়ামের ২০ শতাংশ ব্যবস্থাপনা ব্যয় করতে পারবে।

Advertisement

তবে বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, বীমা কোম্পানির ব্যবসার বয়স ১০ বছর হলে গ্রাহকের জমা করা প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম থেকে ব্যবস্থাপনা ব্যয় করতে পারবে ৯০ শতাংশ এবং পরের বছরগুলোতে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ দুই কোটি টাকার নিচে হলে ১৮ শতাংশ এবং ১০ কোটি টাকার ওপরে হলে ১৫ শতাংশ।

অর্থাৎ ১৯৫৮’র বীমা বিধিমালার চেয়ে খসড়া প্রবিধানে নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে এবং প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ক্ষেত্রে তিন শতাংশ পর্যন্ত বেশি খরচের বিধান রাখা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যয়সংক্রান্ত এমন নীতিমালা হলে গ্রাহকের স্বার্থ ঝুঁকিতে পড়বে। ফলে বীমার প্রতি আগ্রহ হারাবে সাধারণ মানুষ। বীমা খাতে অন্ধকার নেমে আসবে। কেননা, ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেশি হওয়ার কারণেই গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মৃত্যুদাবি, মেয়াদোত্তীর্ণ দাবি ও অন্তর্বর্তীকালীন বোনাস পরিশোধ না করার প্রচুর অভিযোগ উঠেছে বীমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বীমা কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা বাড়ানো হলে জীবন বীমা খাতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। ব্যয় বাড়ানোর কারণে কোম্পানির পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা লাভবান হবেন এবং বীমাগ্রাহকরা ক্ষতির মুখে পড়বেন। আবার ব্যয় বাড়ানোর কারণে বীমা এজেন্টদের আয় যেমন বাড়বে না, তেমনি সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে না।

তিনি বলেন, গ্রাহকরা কষ্টার্জিত অর্থ বীমা কোম্পানিতে ১০, ১২, ১৫ ও ২০ বছরের জন্য জমা রাখে ঝুঁকি মোকাবেলা এবং বৃদ্ধ বয়সের সঞ্চয়ের জন্য। বর্তমানে বীমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকের টাকা থেকে প্রথম বছরে ৯০ শতাংশ এবং পরবর্তী বছরগুলোতে ১৫ শতাংশ হারে ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করছে। বাকি অর্থ বিনিয়োগ করে লাভসহ গ্রাহকদের ফেরত দিচ্ছে। এতে দুই-তিনটি কোম্পানি ছাড়া বাকি কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের কোনো মুনাফা দিতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে ব্যয়ের পরিমাণ যদি এক শতাংশও বাড়ানো হয় তবে তা গ্রাহকদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। মুনাফা তো দূরের কথা কোনো বীমা কোম্পানিই গ্রাহকদের আসল টাকা ফেরত দিতে পারবে না।

অপর এক বীমা কোম্পানির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) বলেন, জীবন বীমা কোম্পানির হিসাব-নিকাশ পেশাদার অ্যাকচুয়ারির কাজ। কিন্তু আমাদের দেশে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা তাদের ক্ষমতা হাতছাড়া করতে চান না। যে কারণে বীমা কোম্পানিগুলোতে অ্যাকচুয়ারিদের মূল্যায়ন করা হয় না। এমনকী অ্যাকচুয়ারি বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তাদের পাত্তাই দেয়া হয় না। অথচ অ্যাকচুয়ারিদের দেখানো পথে কোম্পানিগুলো চললে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। গ্রাহকরা বীমা কোম্পানি থেকে মুনাফা পেতেন।

আরেক বীমা কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) বলেন, যদি অনুমিত ব্যয়ের তুলনায় প্রকৃত খরচ বৃদ্ধি পায় তাহলে কোম্পানি ওই প্রডাক্ট বিক্রি বন্ধ করে দেবে এবং নতুন প্রডাক্ট তৈরি করবে। এক্ষেত্রে আইন পরিবর্তন করে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যয় বাড়ালে গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং জীবন বীমার প্রতি আগ্রহ কমে যাবে। এমনিতে আমাদের দেশে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর ইমেজ খুব একটা ভালো না।

তিনি বলেন, প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের দিকে তাকালে দেখা যাবে তারা ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়ে আনছে। বর্তমানে ভারতে ব্যবসা শুরুর ১০ বছর পূর্ণ করা কোম্পানিগুলো ১০ বছরের বেশি মেয়াদি পলিসির জন্য প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহে ব্যয় করতে পারে ৮০ শতাংশ এবং নবায়নে ১৫ শতাংশ। যা আগের প্রবিধানে ছিল প্রথম বর্ষে ৯০ শতাংশ এবং নবায়নে ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ওপর ব্যবস্থাপনা ব্যয় ১০ শতাংশ কমিয়েছে ভারত। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ভারতে একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রডাক্টের প্রিমিয়াম সমন্বয় করে নতুন প্রডাক্ট ছাড়ে। কিন্তু আমাদের বীমা কোম্পানিগুলো ১০, ১৫ ও ২০ বছরের পুরনো প্রডাক্ট বিক্রি করে যাচ্ছে। এতে অনুমিত ব্যয় ও ভবিষ্যত বিনিয়োগ আয় কী আছে তা ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা কখনও হিসাব-নিকাশ করে দেখেন না। এছাড়া আমাদের দেশে প্রডাক্ট প্রাইসিং এবং ডিজাইনের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমলের মর্টালিটি টেবিল ১৯৪৯-৫২ ব্যবহার করা হয়। আর ভারতে ২০০৬-০৭ টেবিল ব্যবহার করা হয়। পুরনো টেবিল ব্যবহারের ফলে প্রিমিয়ামের হার বেশি হয় এবং গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ প্রসঙ্গে মেঘনা লাইফের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা বাড়ানোর বিষয়টি ভালো না। এটা ভালো লক্ষণ নয়। আগেরটাই ঠিক থাকা উচিত। সম্ভব হলে ব্যয়ের সীমা আরও কমিয়ে আনা উচিত।

যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএ’র সদস্য গোকুল চাঁদ দাস বলেন, ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের যে খসড়া প্রবিধানমালা করা হয়েছে, সেটাই চূড়ান্ত নয়। আমরা বিভিন্ন পক্ষের মতামত নিয়ে এরপর প্রবিধানমালা চূড়ান্ত করব।

এমএএস/এমএআর/বিএ/এমএস