যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে যাতে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি না হয় সেজন্য মাঠপর্যায়ে কীটনাশক ক্রয়-বিক্রয়ে কৃষি কর্মকর্তার প্রেসক্রিপশন লাগবে। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে প্রাথমিকভাবে কৃষি কর্মকর্তাদের প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে কীটনাশক ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য মাঠপর্যায়ে একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পরবর্তী সময়ে এটি সারাদেশে বাস্তবায়ন করা হবে।
Advertisement
এছাড়া কীটনাশকের ক্ষতি থেকে বাঁচতে আরও কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) অভীষ্ট ৩-এ বলা হয়েছে, সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণের প্রধান লক্ষ্য হলো মানব স্বাস্থ্যের ঝুঁকি প্রশমন। ফসল উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহারের হার অনেক বেড়ে গেছে, এর সঙ্গে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। মানবদেহে কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতার পাশাপাশি এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দফতর, সংস্থাকে নিয়ে বিশ্বমানের একটি সিস্টেম প্রণয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নির্দেশনা দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) মো. মোশারফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি খুবই প্রয়োজনীয়। আর সেটা করা সম্ভব হয়েছে উন্নতমানের সার, বীজ ও কীটনাশকের ব্যবহারের মাধ্যমে। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত বালাই নাশকের ব্যবহার আমাদের নানান ঝুঁকির সম্মুখীন করেছে। তাই এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
Advertisement
তিনি বলেন, এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে আলোচনা করে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কৃষি কর্মকর্তাদের প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে কীটনাশক ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য মাঠপর্যায়ে একটি পাইলট প্রকল্প নিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা উইংকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মাহবুব কবীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে ল্যাব টেস্ট করার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় আমদানিকারকরা যে কীটনাশক আমদানির ঘোষণা দিয়েছে তা বাস্তবে আসছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয় না। তাই কীটনাশক পরীক্ষার জন্য ল্যাব স্থাপন ও বিদ্যমান ল্যাবে কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার কথা বলেছি আমরা।’
তিনি আরও বলেন, কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাবে থেকে বাঁচতে পিএইচআই বাস্তবায়ন করতে হবে। ফসলে কীটনাশক প্রয়োগের পর একটি সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়, ওই সময়ের পর ফসল তুলে বাজারে সরবরাহের কথা। কিন্তু সেটা মানা হচ্ছে না। দেখা গেছে, কৃষক সকালে কীটনাশক ব্যবহার করে বিকেলে কেটে তা বাজারে সরবরাহ করছে। ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে মানুষ তা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে। এভাবে চলতে থাকলে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে। কৃষক যাতে পিএইচআই মেনে ফসল কাটে তা জরুরিভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
ন্যূনতম কোন উপজেলা বা কোন ইউনিয়নে পাইলট আকারে কৃষি কর্মকর্তাদের প্রেসক্রিপশের মাধ্যমে কীটনাশক বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সার পরীক্ষার জন্য যে কমিটি আছে সেই কমিটিকে কীটনাশক পরীক্ষার দায়িত্ব দেয়ারও প্রস্তাব দেন মাহবুব কবীর।
Advertisement
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বালাইনাশকের ব্যবহার কমেছে বলা হচ্ছে। আসলে কীটনাশকে একটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট কমেছে কি না, সেটা যাচাই করা দরকার। ট্রাইকোর্ডেমা হার্গা অত্যন্ত বিষাক্ত। এ ধরনের কীটনাশকের লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরিচালক অমিতাভ দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে জনস্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘ এসডিজির টার্গেট বাস্তবায়ন অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যাদির কারণে মৃত্যুঝুঁকি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সেই উদ্দেশ্য পূরণে বেশকিছু কার্যক্রমও আমরা গ্রহণ করেছি।’
অমিতাভ দাস বলেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মানবদেহে ফসলের কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য কৃষিতে একটি বিশ্বমানের সিস্টেম প্রবর্তনের বিষয়ে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া হবে। এ বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি।
কীটনাশক ব্যবহারের বিষয়ে অন্যান্য উদ্যোগগুলো তুলে ধরে অতিরিক্ত সচিব মোশারফ হোসেন বলেন, মাঠপর্যায়ে পিএইচআই (প্রি হারভেস্ট ইন্টারভেল) বাস্তবায়নের জন্য জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হবে। এজন্য কোন পাইলট প্রকল্প নেয়া যায় কি না, এর সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা উইংকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
কীটনাশক ফসলে স্প্রে করার পর ৮ থেকে ১০ দিন বাজারে তোলা বা খাওয়া যাবে না। অর্থাৎ সর্বশেষ স্প্রে করার পর প্রায় সব কীটনাশকের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৮/১০ দিন গ্যাপ দিতে হবে বাজারজাত করতে বা খাবার জন্য। এ সময়ের মধ্যে কীটনাশকের ক্ষতিকর উপাদান দূর হয়ে যায়। এটি হচ্ছে পিএইচআই।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক গোলাম মারুফ বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বালাইনাশক পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য ল্যাবকে কার্যকর করা হবে। প্রয়োজনে অন্যান্য কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের ল্যাবের সহায়তা নেব আমরা। এছাড়া আমদানি করা বালাইনাশক পরীক্ষার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে ল্যাব স্থাপনে দ্রুত ব্যবস্থাও নেয়া হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ উইং থেকে জানা গেছে, কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাবে থেকে রক্ষার জন্য গবেষণার মাধ্যমে আরও ‘জৈব বালাইনাশক’ উদ্ভাবন বা উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ, কীটনাশকের ব্যবহার ঝুঁকি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও কৃষি তথ্য সার্ভিস।
বন্দরে সারের নমুনা পরীক্ষার যে কমিটি রয়েছে সে কমিটিকে কীটনাশক পরীক্ষার দায়িত্ব দেয়া যায় কি না- এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কৃষি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাবে। বিদ্যমান আইন ও বিধি যুগোপযোগী ও হালনাগাদ করা হবে। ক্ষতিকর কীটনাশকের লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন ও মাঠপর্যায়ে সমন্বিত বালাইনাশক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম আরও জোরদার করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
আরএমএম/এমএআর/আরআইপি