বিশেষ প্রতিবেদন

প্রেম থাকলে কাঁটাতার বাধা নয়

স্বপন অধিকারী। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার সহজপুর হাটতলায় থাকেন। ভজন রসে আসক্ত প্রেমিক পুরুষ। গানেই প্রেম, গানেই তার বেঁচে থাকা। ভক্তের প্রেমে বারবার এসেছেন এপারে।

Advertisement

ফকির লালন সাঁইজির ১২৭তম তিরোধান উপলক্ষে স্মরণোৎসবে প্রধান শিল্পী হয়ে গাইতে এসেছেন কুষ্টিয়ার আখড়াবাড়িতে। ভজন গানে নিজে মাতলেন, মাতালেন ভক্তদেরও।

আখড়াবাড়িতেই মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : ভারত-বাংলাদেশ লালন পরিষদের উদ্যোগে স্মরণোৎসবে প্রধান শিল্পী হয়ে গাইলেন। অভিব্যক্তি জানতে চাইছি?

Advertisement

স্বপন অধিকারী : এর আগেও বহুবার এসেছি। তবে এবারে অধিক গুরুত্ব পেয়েছে আমার কাছে লালন স্মরণোৎসব। আমরা সবাই আত্মচেতনা ঘটাতে চাই। সাঁইজির তো সে চেতনারই পথপ্রদর্শক।

জাগো নিউজ : লালন সাঁইজির সময়ে ওপার বাংলাতেও তো সাধুজন ছিলেন?

স্বপন অধিকারী : হ্যাঁ, সাঁইজি যে সময়ে এপার বাংলায় এসে ভজন করলেন, সে সময় আমাদের ওখানে কুবির চাঁন গোঁসাই, যাদুবৃন্দ, নীলকণ্ঠ গোঁসাই, দ্বিজশরৎ, অনন্ত গোঁসাইরা মহাজনী বাণী রচনা করলেন। সাঁইজি যে কথা বলেছেন, তারাও একই কথা বলেছেন।

এ কারণেই এপার বাংলার মানুষের সঙ্গে আমাদের প্রেম, প্রণয়ের মধ্য দিয়ে মালা বদল হয়েছে। সাধকরা যা চাইছেন, আমরা তাই চাইছি। এখানে হিন্দু, মুসলমান, জৈন, খ্রিস্টানের আলাদা কোনো পরিচয় মেলে না।

Advertisement

জাগো নিউজ : তার মানে এমন প্রেমে সীমানা কোনো বাঁধা হতে পারে না

স্বপন অধিকারী : আমরা তো একই। এক বহু, বহু থেকে এক। সাঁইজি এ কথাই বলেছেন। যা থেকে সৃষ্টি তাতেই বিনাশ। সাঁইজি বলেছেন, ‘মরো না, বাঁচো’। বাঁচার কৌশল সাঁইজিও বলেছেন, বাউলরাও বলেন।

জাগো নিউজ : আপনি এই ভাব জগতে কোন বেলায় এলেন?

স্বপন অধিকারী : বাউল আমার ধার করা জিনিস নয়। বাউল শিখে গাওয়া যায় না। বাউল ধারণ করতে হয়। আমার বংশপরম্পরায় বাউলের ভুবনে বিচরণ। বাউল মানে দুটি গান বা সুর নয়। বাউল মানে একটি স্টেজ। একটি সাধনা। বাউলের সাধনা করতে হলে আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্বের অনেক ক্রিয়া আছে। এসব ক্রিয়ার পাশাপাশি সঙ্গীত চর্চা করতে পারলে সাধন-ভজন পোক্ত হয়।

জাগো নিউজ : আপনি গাইলেন যখন, তখন আপনার শরীরও গাইল। আপনার যন্ত্রের সঙ্গে ভক্তরাও দুললেন। তাল-লয়ে এই প্রেমের মুন্সিয়ানা নিয়ে কী বলবেন?

স্বপন অধিকারী : আমার চৌদ্দ পুরুষ গানের মানুষ ছিলেন। আমাকে নিয়ে পনের পুরুষ। আমার ছেলেকেও চাকরি করতে দেইনি। সেও গান করে। গোবিন্দের ইচ্ছাতেই আমরা গানের ভুবন। বাড়িতে এমন কেউ নেই যিনি, দুই-পাঁচখানা গান করতে পারেন না। মেধা ও ঐতিহ্যের সঙ্গেই গায়।

আর সাঁইজির ধামে এসে মন-শরীর তো এমনই দোলে গো। গান তো শিল্পীরা গায় না। তাদের দিয়ে ভক্তরা গাওয়ায়। ভক্তের আবেদনে সাঁই আমাকে দিয়ে খেলাটি খেলে।

জাগো নিউজ : কার কাছ থেকে দীক্ষা নেয়া?

স্বপন অধিকারী : আমার গুরুদেব সাধন দাস বৈরাগী। তিনি এখন দরবেশ হয়েছেন। আমার গুরুদেবের সেবাদাসীর কথা বলে শেষ করা যাবে না। অনেক দেশেই তার সেবাদাসী আছেন। এমনকি জাপানেও। অনেকেই তরুণী। তাদের সঙ্গে কিন্তু গুরুদেবের কাম সম্পর্ক নয় গো। প্রেমই সেখানে মুখ্য। কাম-আর প্রেম যোজন যোজন দূরে।

জাগো নিউজ : খোমক বাজিয়ে উন্মাদ করে দিলেন ভক্তদের। ঠিক হারমোনিয়ামেও। কয়টি যন্ত্রে এমন দখল?

স্বপন অধিকারী : প্রচলিত যন্ত্র সবই বাজাতে পারি। খোল, ঢোল, পাকই, ড্রাম, সাইট ড্রাম, হারমোনিয়াম, দোতরা, ব্যঞ্জসহ অনেক যন্ত্রেই দখল রয়েছে। তবে খোমকটাই আমার প্রধান যন্ত্র।

জীবনে এই খোমকেই আমি পাথেয় করেছি। ওর হাত ধরেই এতগুলো যন্ত্রে প্রেম। ও আমার বন্ধু। মায়ের পরে খোমকই আমার ভালো বন্ধু। আমার বেঁচে থাকাটা ওর জন্যই। আমাকে বাঁচিয়ে রেখছে ওই।

জাগো নিউজ : আনন্দ কার জন্য বেশি। ভক্ত নাকি নিজের জন্য?

স্বপন অধিকারী : আমি আমার জন্য গান গাই। দয়ালকে স্মরণ করেই গান করি। সে আনন্দ পেলেই আমি আনন্দ পাই। আমি সাধক নই। তবে যদুও নই।

সবই তো নিলাম। এখন ত্যাগের পালা। ত্যাগেই আনন্দ।

জাগো নিউজ : কেমন পেলেন এপারের ভক্তদের?

স্বপন অধিকারী : প্রেম দরিয়ায় ডুব দিলাম তো। অসংখ্য ভক্ত আমার এপারে। তাদের টানেই তো আসি। প্রেম তো বলে কয়ে হয় না। প্রেম হয় সাধনায়। তারই খানিক নিয়ে গেলাম এবার।

এএসএস/এমএআর/বিএ