খেলাধুলা

ওয়ালশ নয়, ইমরানের কাঠগড়ায় সিস্টেমও

পেস বোলিং ডিপার্টমেন্টের দূর্বলতা নিয়ে নানা কথা বার্তায় আপনা-আপনি চলে আসছে পেস বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশের নাম। সন্দেহ নেই ওয়ালশ ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সব সময়ের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার। সাফল্যের নিরীখে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলারের তালিকায়ও তার নাম আছে। থাকবেও। এমন এক জীবন্ত কিংবদন্তীতুল্য কোচ কাজ করছেন এক বছরের বেশি সময় ধরে।

Advertisement

তারপরও বাংলাদেশের পেস বোলিং ডিপার্টমেন্টের এমন ভগ্ন দশা। কেন? দেশের ক্রিকেটের প্রতিষ্ঠিত প্রশিক্ষক, সাবেক পেস বোলার এবং বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের পেসারদের নিয়ে কাজ করা সারোয়ার ইমরান পেস বোলারদের জীর্নদশা, দূর্বলতা ও অকার্যকরিতার জন্য সরাসরি কোর্টনি ওয়ালশকে এতটুকু দায়ী করতে রাজি নন।

অনেক কথার ভীড়ে সারোয়ার ইমরান পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, ‘পেস বোলিং ডিপার্টমেন্টের দূর্বলতা, ঘাটতি ও সীমাবদ্ধতার কারণ খুঁজে বের করতে হলে অনেকগুলো প্রাসঙ্গিক ও আনুসাঙ্গিক বিষয় আগে খুঁটিয়ে দেখতে হবে। তা না করে কোর্টনি ওয়ালশের দোষ খোঁজা কিংবা কোচিং মেথডের দূর্বলতার কথা ভাবলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, এখন যে পেস বোলিং ডিপার্টমেন্টকে দূর্বল ও কমজোরি মনে হচ্ছে- সেটা একটা দীর্ঘ মেয়াদি কার্যক্রমের নেতিবাচক প্রভাব।’

কি সেই দীর্ঘ মেয়াদি নেতিবাচক কার্যক্রম? জানতে চাইলে সারোয়ার ইমরান বলে ওঠেন, ‘খুব ভাল মত খেয়াল করুন, দেখবেন- গত এক থেকে দেড় বছরে বাংলাদেশ জাতীয় দলের পেস ডিপার্টমেন্টে একটা বাজে প্র্যাকটিস গড়ে উঠেছে। তাহলো , বেশিরভাগ সময় দেখা যাচ্ছে কেউ একজন ইনজুরির শিকার হয়েছে, রিহ্যাব করছে- সেখান থেকে সুস্থ হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত না খেলে দীর্ঘ সময় অনুশীলন না করে আবার দলে ফিরে আসছে। প্রায় প্রত্যেক বোলার এভাবেই ইনজুরি থেকে উঠে কিংবা রিহ্যাব করতে করতে দলে এসে ঢুকছে।’

Advertisement

এ কারণেই মূলতঃ ফিটনেস থাকছে না বলে মনে করেন সারোয়ার ইমরান। তিনি বলেন, ‘যে কারনে শতভাগ ম্যাচ ফিটনেস থাকছে না বোলারদের। একজন বোলারের স্বাভাবিক ছন্দে ও পূর্ণ গতিতে বল করতে যে পরিমাণ চর্চার সময় লাগে, তা তারা পাচ্ছেন না। বা দেয়া হচ্ছে না। তারাই আবার সিরিজ বা টুর্নামেন্ট খেলতে যাচ্ছে। তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই সামর্থ্যরে সেরাটা উপহার দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

গুঞ্জন আছে, বাংলাদেশের পেসাররা বিশেষ করে রুবেল হোসেন, শফিউল ইসলামরা ওয়ালশের কথা ঠিকমত বুঝতে পারেন না। তাই এমন বিপত্তি। এ প্রসঙ্গে সারোয়ার ইমরানের ব্যাখ্যা ‘বোলারদের ইংরেজি ভাল জানার এবং ওয়ালশের কথা খুব ভাল বোঝার দরকার নেই। পেস বোলাররা বোবা বোলিং কোচের ভাষাও বুঝবে। কারণ, তিনি বল হাতে নিয়ে গ্রিপ দেখাবেন। সেলাইয়ের কোন জায়গায় ধরলে কি হবে? কখন কোন লাইন ও লেন্থে বল করতে হবে? এসব কথাই বলেন কোচ। তা যে ভাষাতেই বলুন না কেন, বোলাররা ঠিক বুঝে ফেলে।’

ক্রিকেটীয় ভাষাই এখানে মূখ্য। সেটাই বোঝালেন সারোয়ার ইমরান। তিনি বলেন, ‘আসলে ওয়ালশ আর যেই হোন, তার কথা বা ভাষা না বোঝার কিছু নেই। ক্রিকেটীয় ভাষা ও পেস বোলিংয়ের নিজস্ব ভাষা আছে। সেগুলো আমাদের ছেলেদের ভালই জানা। কখন কি করবে, কখন কোন গ্রিপে স্লোয়ার ছুঁড়বে? আমাদের ছেলেরা এগুলো বুঝে না, আমি তা বিশ্বাস করতে চাই না। আর সবচেয়ে বড় কথা আমাদের ছেলেরা অনেক দিন ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছে। কাজেই কোচের ভাষা, কথা ও পরামর্শ না বোঝার কোন কারণ দেখি না।’

ওয়ালশের কোচিং মেথড নিয়ে নেতিবাচক বহুদুরে, একটি কথাও বলতে রাজি হননি ইমরান। তার কথা, ‘আমি দেখিনি। তাই সরাসরি মন্তব্য করতে পারবো না। ঠিকও হবে না। তবে এটুকু বিশ্বাস করি, আন্তর্জািিতক ক্রিকেটে সফল হতে একজন পেসারের যে জ্ঞান ও গুণাবলি দরকার, তা ওয়ালশ খুব ভালই শেখাতে পারবেন।’

Advertisement

তাই যদি হয়, তাহলে আমাদের পেসারদের মূল সমস্যা কোথায়? এর উত্তরে সারোয়ার ইমরানের ব্যাখ্যা, আসলে দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দরকার সত্যিকার ফাস্ট বোলার। যারা ১৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করতে পারবে। ওই গতিতে বল করতে না পারলে সুইং আর নিয়ন্ত্রণটা খুব জরুরী। এর সাথে বোলিং বৈচিত্র্যছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকান ও অস্ট্রেলিয়ান কন্ডিশনে ফাস্ট বোলিং দিয়ে কিছু করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় সব বোলারই ১৩০ কিলেমিটার গতিকে বল করে। যা দিয়ে সফল হওয়া খুব কঠিন। পেস কম হলে বৈচিত্র্য লাগবে। সুইং লাগবে। লাইন লেন্থ ঠিক রাখতে হবে। মাশরাফি যেমন বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করছে। তাকে সেভাবে মারতে পারেনি। তেমন বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা লাগবে। এই জায়গায় ঘাটতি আছে।’

ইমরানের শেষ অনুভব, ‘আমাদের বোলাররা ঘরের মাঠেও অনুকুল ক্ষেত্র পায় না। এটাও তাদের মান বেড়ে না ওঠার একটা অন্যতম কারণ। আমাকে বোলিং উইকেট দিলেই যে আমি সব ধ্বংস করে ফেলবো আমার বল কেউ খেলতে পারবে না- এমন নয়। বোলিং উইকেটে বোলিং করাও শিখতে হয়। কি করে বোলিং উইকেটের সর্বোচ্চ ফায়দা নিতে হয়? তাও জানতে, বুঝতে আর শিখতে হয়। আমাদের ছেলেরা তা জানার, বোঝার আর শেখার ক্ষেত্র পাচ্ছে কই?’

ঘরোয়া লিগের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে বিশেষ করে ঢাকা লিগে খেলছি একজন পেসার নিয়ে। এমনকি জাতীয় লিগ বা বিসিএলে চার দিনের ম্যাচেও দুই পেসার নিয়ে নেমে যাচ্ছি। তারা একদিনে গড়পড়তা ১০ ওভারও বল কওে না। বা করার সুযোগ পায় না। এমনকি আমরা ঘরে মাঠে টেস্ট আর ওয়ানডে খেলতে নামছি এক বা দুজন মাত্র পেসার নিয়ে। এতে করে পেসার নির্ভরতা যাচ্ছে কমে।’

পেস বোলাররা মনের দিক থেকেও তৈরি হচ্ছে না। তারা নিজেদের স্পিনারদের সহায়ক শক্তি ভাবতে শিখছে। এতে করে মনের দিক থেকে তেড়েফুঁড়ে কিছু করার অদম্য ইচ্ছেটা যাচ্ছে কমে। আর শারীরিক ও ক্রিকেটীয় প্রস্তুতিও নিচ্ছে দায়সারা গোছের।

তারা জানে, সুযোগ পাবো না। আর একাদশে থাকলেও চার পাঁচ বা ছয় ওভারের বেশি বল করতে হবে না। হয়ও না। সেই তারা যখন উপমহাদেশের বাইরের কন্ডিশনে খেলতে যাচ্ছে তখন সমস্যা হবে বৈকি। এ সমস্যার সমাধান রাতারাতি হবে না।’

এআরবি/আইএইচএস/আইআই