দেশজুড়ে

পৌনে দু’মাসে ২৬ নৌকাডুবিতে ১৮২ রোহিঙ্গার সলিল সমাধি

শত কড়াকড়ির পরও থামানো যাচ্ছে না ঝুঁকি নিয়ে মিয়ানমার থেকে রাতের বেলায় নৌকায় পারাপার। এ কারণে রোধ করা যাচ্ছে না নৌকাডুবির ঘটনাও। ফলে বাড়ছে রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও পুরুষের লাশের মিছিল।

Advertisement

সোমবার ভোররাতে রোহিঙ্গা বোঝাই আরও একটি নৌকা টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ উপকূলে এসে ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১১ রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়াদের মাঝে ছয় নারী ও পাঁচজন শিশু।

এ ঘটনায় জীবিত ২১ জনকে উদ্ধার করা হয়। ২৯ আগস্ট থেকে ১৬ অক্টোবর এক মাস ১৯ দিনে রোহিঙ্গা বোঝাই ২৬টি নৌকাডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৮২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব সলিল সমাধি স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ জনগণকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছে।

রাখাইনে এখনও নিপীড়ন ও পাশবিকতা চলমান থাকায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে বলে উল্লেখ করেছেন জীবিত উদ্ধার হওয়ারা।

Advertisement

কোস্টগার্ড শাহপরীর দ্বীপ স্টেশন কমান্ডার লে. জাফর ইমাম শরীফ জানিয়েছেন, সোমবার সকাল ৮টার দিকে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিম পাড়া বেড়িবাঁধ ভাঙার কাছাকাছি সাগর থেকে প্রথমে ৮টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে বেলা ১১টার দিকে আরও তিনটি মরদেহ ভেসে আসার খবর পেয়ে তা উদ্ধার করা হয়েছে।

জীবিত উদ্ধার রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, রাখাইনের নাইক্যংদিয়া থেকে ৫০-৬০ জন রোহিঙ্গা বোঝাই একটি নৌকা শাহপরীর দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছালে সোমবার ভোররাতে ঢেউয়ের তোড়ে ডুবে যায়। এতে কেউ সাঁতরে বা কেউ ঢেউয়ের ধাক্কায় তীরে চলে আসে। আর বাকি অনেকে নিখোঁজ হন। খবর পেয়ে সকাল ৮টার দিকে কোস্টগার্ডের একটি দল স্থানীয়দের সহযোগিতায় সেখানে অভিযান চালিয়ে ২১ জন জীবিত ও প্রথমে আটজনের মরদেহ উদ্ধার করে।

জীবিত উদ্ধার রফিক আহমদ ও ছেনুয়ারা বেগম দম্পতি বলেন, মিয়ানমার সেনারা তাদের গ্রামে এখনও নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। কাউকে কোথাও বের হতে দিচ্ছে না। তাই নাওয়া-খাওয়া নিয়ে চরম বেকায়দায় শত শত গ্রামবাসী। আবার সামনে পেলে পুরুষদের ধরে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রয় ও খাবার পাওয়ার কথা শুনে প্রাণ বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে সন্তানসহ নৌকায় উঠি। রোববার রাতে মংডু গুদামপাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসার পথে সোমবার ভোরে শাহপরীর দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছে ঢেউয়ের তোড়ে নৌকাটি উল্টে যায়। নৌকায় প্রায় ৬৫ জনের মতো রোহিঙ্গা ছিল। এদের মধ্যে অধিকাংশ নারী ও শিশু ছিল। তাদের সন্তানদের এখনও খুঁজে পাননি বলে জানান তারা।

টেকনাফ মডেল থানা পুলিশের ওসি মাইন উদ্দিন খান বলেন, শাহপরীর দ্বীপের কাছাকাছি রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবির ঘটনায় ছয় নারী ও পাঁচ শিশুসহ ১১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিখোঁজদের সন্ধান চলছে।

Advertisement

অপর একটি সূত্র জানায়, গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১১টার দিকে শাহপরীর দ্বীপের গোলারচর এলাকায় রোহিঙ্গা বোঝাই দুটি নৌকা তীরে ভিড়ে। ওই দুই নৌকায় ১৯ জন পুরুষ, ১৭ নারী ও ২২ জন শিশু ছিল। আর নৌকাগুলো তীরে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজিবি নৌকা দুটির যাত্রী ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৯ মাঝিকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

ওই সময় দায়িত্বপালনকারী বিজিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, রোহিঙ্গারা ইয়াবা নিয়ে আসতে পারে তাই সবাইকে তল্লাশি করে সকালে ক্যাম্পে পাঠানো হবে। আর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রোহিঙ্গাদের আনায় নৌকা দুটি ভেঙে ফেলা হবে।

পরদিন তাই ঘটে। এরপরও থামছে না রোহিঙ্গাদের ঝুঁকিপূর্ণ পারাপার।

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন জানান, গত ৮ অক্টোবর মধ্যরাতে শাহপরীর দ্বীপ গুলারচরে রোহিঙ্গা বোঝাই একটি নৌকাডুবির ঘটনায় ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৩৮ মরদেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। হিসাব মতে, গত ২৯ আগস্ট থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গা বোঝাই ২৬টি নৌকাডুবির ঘটনায় ১৮২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮১ জন রোহিঙ্গা। অন্যজন বাংলাদেশি নৌকার মাঝি। রোহিঙ্গাদের লাশের মধ্যে ৯১ জন শিশু, ৬২ জন নারী ও ২৯ জন পুরুষ। উদ্ধার হওয়া স্থানে কাছাকাছি কবরস্থানেই তাদের দাফন করা হয়েছে।

সায়ীদ আলমগীর/এমএএস/আইআই