সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও স্থানীয় জনগণ কাদের মোল্লাসহ সব মানবতাবিরোধীদের ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চে আন্দোলন করছে। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। শুরুতেই গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা মশাল মিছিলে নড়াইল শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিলের প্রথম সারিতে মশাল মিছিলে অংশগ্রহণ করি। খুব কাছ থেকে দেখছি- সব শ্রেণির মানুষ দেশের স্বার্থে কতটা একাগ্র। আজ আমিও তাদের একজন। যুদ্ধ দেখিনি। তবে মনে হলো, আমিও আজ যুদ্ধে আছি। রক্তের মধ্যে কেমন যেন একটি অনুভূতি খেলা করছে। এখানে না এলে কখনো দেশকে এতটা অনুভব করতে পারতাম না। বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়। তাদের মুখ থেকেই শুনতে পেলাম, সেদিন কতটা ভয়ানক ছিলো।
Advertisement
মহান মুক্তিযুদ্ধে নড়াইল জেলার বিশেষ অবদান রয়েছে। নড়াইল জেলা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুক্তিযোদ্ধা অধ্যুষিত জেলা। এ জেলা থেকে প্রায় ২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেছেন। দেশের ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ’র একজন ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ নড়াইলের কৃতি সন্তান। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ নড়াইল মহাকুমার প্রশাসক কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর নেতৃত্বে অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ, আব্দুল হাই এবং অন্যান্যের সহযোগিতায় নড়াইল ট্রেজারির তালা ভেঙে অস্ত্র নিয়ে যশোর সেনানিবাস আক্রমণের মধ্য দিয়ে এ জেলার মানুষের মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়। অগণিত মুক্তিযোদ্ধার রক্ত এবং অনেক অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত মা-বোনের অশ্রু ও সংগ্রামের ফলে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর নড়াইল হানাদার মুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে শাহাদাৎ বরণকারীর সংখ্যাও একেবারে কম নয়। পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক চিত্রা নদীর পাড়ে লঞ্চঘাটের পন্টুনের ওপর ২ হাজার ৮শ’ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন- পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : প্রথম পর্ব
রাত ৯টায় সবুর আমাকে নিয়ে তার বাসায় গেলেন। তিনি থাকেন টিএন্ডটি’র কোয়াটারে। তার বাসাতেই রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবুরের স্ত্রীও বন্ধুসুলভ মানুষ। খাবারের আয়োজন দেখে আমার চোখ তো কপালে উঠে গেছে। বিভিন্ন ধরনের খাবার, তার সাথে বাহারি পিঠা। খাবার খেতে বেশ কয়েকজন প্রতিবেশীও চলে এলো আমাকে দেখতে। খাবার শেষে সবুর বললেন, ‘শাকিল, চলো স্কুল মাঠে। সেখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমার মেয়ে অনুষ্ঠানে গান করবে। সে সারা দিন তোমার অপেক্ষায় বসে ছিলো। তোমাকে দেখবে বলে। ভোরে যেহেতু তুমি চলে যাবে। আর তোমার সাথে যদি মেয়েকে দেখা না করাই তাহলে আমাকে মেরে ফেলবে।’ মোটরসাইকেলে করে আমাকে অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলেন। বিশাল মাঠ। এখানেই সবার প্রিয় ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজার খেলাধুলার হাতেখড়ি। আমাকে অনুষ্ঠান মঞ্চে নিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিলেন। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে আমার দীর্ঘ পথ হাঁটার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শেয়ার করলাম। তারপর সবুর সাহেবের মেয়ের সঙ্গে দেখা করে চলে এলাম।
Advertisement
আগেই বলেছি, আজ আমার বিছানা ঘরের মেঝেতে। একা একা শুয়ে আছি। কথা বলার কেউ সাথে থাকলে হয়তো রাতটা আরেকটু ভালো হতে পারতো। টেবিলের ওপরে একটা পুরনো ম্যাগাজিন পেলাম। সেটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলাম। এখানে নড়াইল নিয়ে কিছু লেখা পেলাম। যা নড়াইল সম্পর্কে অনেক কিছু জানালো আমাকে। আমি যা জানতে পারলাম, তা আপনাদেরকেও বলছি। নড়াইল জেলার নামকরণের বেশ কয়েকটি ইতিহাস আছে। কথিত আছে, বাংলার সুবাদার আলীবর্দী খানের শাসনামলে দেশের বিভিন্ন অংশে বর্গী ও পাঠান বিদ্রোহীরা নানা ধরনের পীড়ন শুরু করে। আলীবর্দীর মুঘল বাহিনী বর্গী ও পাঠানদের সম্পূর্ণ শায়েস্তা করতে ব্যর্থ হন। এরপর বর্গী ও পাঠান দস্যুরা তাদের অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
আরও পড়ুন- পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : দ্বিতীয় পর্ব
সুবা বাংলার পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের অধিবাসীরা প্রাণভয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকায় পালাতে থাকে। সেই সময় মদনগোপাল দত্ত নামে সুবাদারের এক কর্মচারী কিসমাত কুড়িগ্রামে সপরিবারে নৌকাযোগে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি কচুড়ির শক্ত ধাপের উপর একজন ফকিরকে যোগাসনে উপবিষ্ট দেখতে পান। ওই ফকির দত্ত মশায়ের প্রার্থনায় তার নড়িটি (লাঠি) দান করেন এবং এই নড়ি পরবর্তীতে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। মদনগোপাল দত্ত ফকির বা সাধক আউলিয়ার নড়ি বা লাঠি পেয়ে ধীরে ধীরে প্রতিপত্তি অর্জন করেন। এইভাবে কিসমাত কুড়িগ্রাম অঞ্চলের ওই স্থানের নাম হলো ‘নড়াল’। নড়ালের লেখ্য রূপ হলো ‘নড়াইল’। স্থানটি নড়িয়াল ফকিরের নড়ি থেকে পরিচিতি লাভ করে। মদনগোপাল দত্তের পৌত্র বিখ্যাত রূপরাম দ্ত্ত। রূপরাম দত্তই নড়াইলের জমিদারদের প্রথম পুরুষ। যা হোক, মদনগোপাল দত্ত ও তার উত্তরাধিকারীরা নড়িয়াল ফকিরের অতি শ্রদ্ধাবশত নড়াল নামটি স্থায়ী করেন।
গবেষক এস এম রইস উদ্দীন আহমদের মতে, লড়েআল থেকে নড়াইল নামের উৎপত্তি হয়েছে। যারা শক্রর বিরুদ্ধে লড়াই করে স্থানীয় ভাষায় তাদের লড়ে বলে। হযরত খান জাহান আলীর সময়ে রাজ্যের সীমান্তে প্রহরী নিয়োজিত ছিল। নড়াইল এলাকা নদী-নালা, খাল-বিল বেষ্টিত। খাল কেটে রাজ্যের সীমান্তে পরীখা তৈরি করা হতো। খাল বা পরীখার পাশে চওড়া উঁচু আইলের ওপর দাঁড়িয়ে লড়ে বা রক্ষী সেনারা পাহারা দিত। এভাবে লড়েআল থেকে লড়াল এবং লড়াল থেকে নড়াইল নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। আরেকটি প্রচলিত মত হলো, নড়ানো থেকে নড়াইল নামের উৎপত্তি হয়েছে। বাংলাদেশে অনেক স্থানের নামের সাথে ইল প্রত্যয় যুক্ত আছে। যেমন- টাঙ্গাইল, ঘাটাইল, বাসাইল, নান্দাইল ইত্যাদি। প্রত্যেকটি স্থানের নামকরণের ক্ষেত্রে কিছু কিংবদন্তি বা লোককাহিনি প্রচলিত আছে। একটি বড় পাথর সরানোকে কেন্দ্র করে নড়াল বা নড়াইল নামের উৎপত্তি বলেও কেউ কেউ মনে করেন।
Advertisement
আরও পড়ুন- পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : তৃতীয় পর্ব
নড়াইল জেলায় রয়েছেন অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। তাদের মধ্যে বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন ফজলুল হক মন্ত্রিসভার মন্ত্রী সৈয়দ নওশের আলী, কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান, ভূবনখ্যাত শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্কর, উপমহাদেশের বিখ্যাত সেতার শিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর, চারণ কবি মোসলেমউদ্দিন, কবিয়াল বিজয় সরকার, ৫০টি উপন্যাসের রচয়িতা ডা. নিহার রঞ্জন গুপ্ত, তেভাগা আন্দোলনোর মধ্যমণি নূর জালাল, নজরুল সঙ্গীতের নির্ধারিত সুরকার কমলদাশগুপ্ত, প্রখ্যাত মঞ্চাভিনেতা অমলকৃষ্ণ সোম, সর্বকনিষ্ঠ শহীদ বুদ্ধীজীবী শেখ আব্দুস সালাম এবং বীরশ্রেষ্ঠ নূর মুহাম্মদ। এছাড়া নড়াইলের কিংবদন্তিতুল্য ফকির দরবেশ ও ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে ফকির ওসমান, সাধক লেংটা শাহ, বুড়ো দেওয়ান, গঙ্গাধর পাগল অন্যতম।
এসইউ/পিআর