বিশ্ব ডিম দিবস ১৩ অক্টোবর। ডিমের গুণাবলি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ১৯৯৬ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে দিবসটি একযোগে পালিত হয়ে আসছে। এ উপলক্ষে রাজধানীর খামারবাড়িতে তিন টাকা পিস দরে ডিম বিক্রির আয়োজন করেছে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এবং সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর (ডিএলএস)। এবারের ডিম দিবসের স্লোগান, ‘সুস্থ সবল জাতি চাই, সব বয়সেই ডিম খাই।’
Advertisement
বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ শিল্পের বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও ঝুঁকি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন সেন্ট্রাল কাউন্সিলের কনভেনার মশিউর রহমান। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক মামুন আব্দুল্লাহ।
জাগো নিউজ : এই শিল্পের বিকাশকাল কবে থেকে বলা যেতে পারে?
মশিউর রহমান : মুরগির খামার বা এ খাত মূলত ৯০ এর দশকে শুরু থেকেই বাংলাদেশে নতুন রূপ ধারণ করে। ৯০ এর আগে ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে খামার ডিম উৎপাদন হতো। কোনো কোনো জায়গায় ২০০ থেকে ৫০০ ডিম উৎপাদন হতো। ১ হাজার ডিম উৎপাদনকারীদের বলা হতো বড় খামারি।
Advertisement
জাগো নিউজ : একসময় তো মানুষ নিজ উদ্যোগেই মুরগি আর ডিম উৎপাদন করত।
মশিউর রহমান : এর আগে মূলত গ্রাম-গঞ্জের বাড়িতে বাড়িতে ২০-২৫টা মুরগি পালত। ওইসব ডিম দিয়ে বাড়ির সদস্যদের চাহিদা মেটতো, বাকি ডিম বিক্রি করে তারা পান-সুপারি কিনত। অনেক সময় তারা সাপ্তাহিক বাজারে নিয়ে এসব ডিম বিক্রি করতো। ওই ডিম বিক্রির টাকা দিয়ে তাদের বাজারসদাই চলতো।
জাগো নিউজ : ডিম তো এখন শুধু ইন্ডাস্ট্রি নয় বিজ্ঞান?
মশিউর রহমান : দেশে মূলত ডিম ব্যবসায় বিপ্লব ঘটেছে বলা চলে। ৯০ এরপর সেটা ফার্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরপর এটা আসে ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে। এখন আমরা বলি ডিম ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড সায়েন্স। এর মানে ব্যাপারটা অনেক ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সেক্টরটা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।
Advertisement
জাগো নিউজ : ডিমের উৎপাদনের সঙ্গে ভোক্তা কেমন বেড়েছে?
মশিউর রহমান : ৯০ এর প্রথম দিকে একজন মানুষ বছরে গড়ে মাত্র ১০টা ডিম খেত। কারণ ডিম যে পুষ্টি হিসাবে অনেক ভাল. মানব দেহে দরকার এটা মানুষ জানত না। এটার এত প্রচার-প্রচারণা ছিল না। মানুষ জানতও না। যখন মানুষ ডিমের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বুঝতে শুরু করল। তখন এর উৎপাদন বাড়তে শুরু করল।
গত ১০ বছর আগেও মানুষ গড়ে ২০টা ডিম খেত। এখন মানুষ গড়ে মানুষ ৫৫টা ডিম খায়। একজন মানুষের গডে ১০৫-১১০টা ডিম খাওয়া উচিৎ। এটা স্টান্ডার্ড, পুষ্টিবিদদের মত।
জাগো নিউজ : উন্নত দেশে কী হারে ডিম খায় মানুষ— এমন কোনো তথ্য আছে কী?
মশিউর রহমান : উন্নত কিছু কিছু দেশ যেমন জাপানসহ আরো কয়েকটা দেশের নাগরিকরা বছরে গড়ে ৬০০ ডিম থেয়ে থাকে। অনেকে অন্য খাবার কম খেয়ে এর চেয়ে আরও বেশি ডিম খায়। কেক দিয়ে খায়, বিস্কিট দিয়ে খায়, জুস বানিয়ে খায়, কেউ ড্রিংস বানিয়ে খায়। অনেকে সকালে কাচা ডিম দিয়ে নাস্তাও করে। এভাবে তারা বছরে প্রচুর ডিম খায়। এ জন্য গড়ে তাদের প্রতিদিন দুটি করে ডিম খাওয়া হয়ে যায়। এতে তাদের স্বাস্থ্যও ভাল থাকে।
এর মানে হলো শরীরের স্বাভাবিক রিকোয়ারম্যান্ট ১০৫-১১০টা ডিম। এটা তারা ফিলআপ করে। কারণ যেসব উন্নত জাতি বুঝতে পারছে, পুষ্টি নিয়ে পড়াশোনা করে তারা ডিম ঠিকই খায়। আমাদের দেশে ডিমের এত ব্যবহার নেই। তাই ডিমের ভোগ গড়ে ৫৫টাতেই রয়ে গেছে। গ্রামে অনেক মানুষ আছে যারা বছরেও দুটি ডিম খাওয়ার প্রয়োজন মনে করে না।
জাগো নিউজ : ডিমের ভোক্তা বাড়াতে এই মুহূর্তে কী প্রয়োজন?
মশিউর রহমান : ডিম যে একটা উপকারী খাবার এটা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। এই জানানোটা শুরু করেছি গত ৪-৫ বছর যাবৎ । এরপর ডিম দিবস যে হয় সেটাও পালন করতে শুরু করেছি।
জাগো নিউজ : এখন আসি অন্য প্রসঙ্গে। মেলা উপলক্ষে হঠাৎ ডিম কম দামে ডিম বিক্রির সিদ্ধান্ত কেন?
মশিউর রহমান : আমরা প্রচারণার অংশ হিসাবে এটা শুরু করেছি। টিভিতে যারা খাদ্যপুষ্টি নিয়ে রিপোর্ট করে, তাদেরকে ডিম সম্পর্কে বেশি বেশি বলার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছি। ব্রেস্ট ফিডিং অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কাজ শুরু করেছি। প্রচারণার অংশ হিসেবে আমরা স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিম নিয়ে প্রচার-প্রচারণা করেছি। একইসঙ্গে ডিম সম্পর্কে যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে সেগুলো দূর করার চেষ্টা করছি।
জাগো নিউজ : এখন তো অধিক স্বাস্থ্য সম্মতভাবে উৎপাদন হচ্ছে?
মশিউর রহমান : মনে রাখতে হবে, এখন ভোক্তার কাছে খামার থেকে মাত্র ২ -৩ দিনের ব্যবধানে ডিম চলে আসে। আগে গ্রাম-গঞ্জ থেকে এই ডিম শহরে আসতে মাসও লেগে যেত। কিন্তু এখন সেটা হয় না। তাই তাজা ডিম খাচ্ছে মানুষ। আর মান সম্মত খাবার খাইয়ে এই মুরগি পালা হয়। সুতরাং পুষ্টিগুণ একটু বেশিই বলা যায়।
জাগো নিউজ : ভোগের হার বেড়েছে, কিন্তু কি হারে বেড়েছে?
মশিউর রহমান : গত ৩-৪ বছরের পরিসখ্যান যদি দেখি মানুষের মধ্যে ডিম ভোগের পরিমাণ প্রতি বছর ১৮- ২০ শতাংশ হারে বেড়েছে। এখাবে বাড়তে থাকলে আগামী ২০২০-২১ সাল নাগাদ জন প্রতি একজন মানুষ ১০০ টার বেশি ডিম খাবে। এজন্য যদি মানুষ এখনকার তুলনায় দ্বিগুণ হারে ডিম ভোগ করতে খাকে তবে সে অনুসারে উৎপাদন বাড়াতে হবে।
জাগো নিউজ : উৎপাদন কি সে হারে বেড়েছে?
মশিউর রহমান : আমি বলতে চাই, ডিমের যে চাহিদা বাড়ছে, সেটা পূরণের জন্য ডিমের ইন্ডাস্ট্রিও সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখাতে বিনিয়োগও বাড়ানো হচ্ছে। ১০০টা ডিমের চাহিদা পূরণের জন্য যে পরিমাণ ডিমের ফার্ম দরকার। সে পরিমাণ ফার্ম তারা করবে।
তিনি বলেন, গত ১ দশকে ডিমের চাহিদা যে হারে বেড়েছে, উৎপাদন সে হারে বেড়েছে। বরং উৎপাদন একটু বেশি বেড়েছে। এর মানে হলে উৎপাদন বেড়েছে ২০-২২ শতাংশ। যার ফলে ডিমের দামটা একটু কম। ডিমান না খাকলে দাম তো কমবেই।
জাগো নিউজ : পাইকারদের কাছ থেকে মানুষ ডিম বেশি দামে কিনছে কি?
মশিউর রহমান : ডিমের দামটা মূলত ঠিক হয় প্রতিদিনের দিনেরটা প্রতিদিন। পাইকাররা একটা রেট দেয় সে অনুসারেই ডিম বাজারে আসে। এটা প্রতিযোগিতামূলক বাজার। ডিম বিক্রি করে মধ্যস্বত্বভোগীরা খুব বেশি লাভ করে না। কারণ খামার থেকে পাইকারি বাজারের ডিমের দামের পার্থক্য থাকে ১-২ টাকা। এর থেকে বেশি থাকে না।
এর মানে পাইকাররা এখন বাজারে সারে ৫ টাকা দরে ডিম কিনে সাড়ে ৬ টাকা দরে বিক্রি করছে। খুচরা বাজারে সেটা ৭ বা সাড়ে ৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝে মাঝে সেটা ঈদ বা রোজার সময় সেটা ৪ টাকায় নেমে আসে।
জাগো নিউজ : এ খাতে কি ধরনের ঝুঁকি আছে বলে মনে করেন?
মশিউর রহমান : দেশে বার্ড ফ্লু হয়েছিল। তাতে দেশের পোল্ট্রি সেক্টরে অনেক ক্ষতি হয়েছিল। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে আমরা একটু দাঁড়িয়েছি।
অনেক সময় দেখা যায়, বার্ড ফ্লুর অনেক রোগে ঘুরে ফিরে অন্য রূপে আসে। আমাদেরকে সেটার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে। সরকারকে এই বিষয়ে গবেষণা বাড়াতে। নিজস্ব উপাদান দিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি করতে হবে। দেখা যায়— কোনো রোগ হলেই বিদেশ থেকে ভেক্সিন আনতে হয়। সেই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
জাগো নিউজ : সরকারের কাছে কোনো ধরনের সহায়তা চান কি? মশিউর রহমান : সরকারের ব্যাপক সহযোগিতা প্রয়োজন।
জাগো নিউজ : কী ধরনের সহায়তা?
মশিউর রহমান : একসঙ্গে গবেষণা কার্যক্রম বাড়ানো ও নীতি সহায়তা দরকার। পলিসি লেভেলে যে চিন্তা ভাবনা থাকা দরকার ছিল সেটা নাই। যেমন বার্ড ফ্লু আসছিল, সেটা নিরাময় ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যে লেগে থাকতে হবে সেটা নাই।
ডিম খাওয়ার প্রচলন বাড়িয়ে মানুষকে অনেক রোগ থেকে বাঁচানো সম্ভব। ডিমের যে যে উপকারিতা আছে, সেটা সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সবার মধ্যে প্রচারের ব্যবস্থা থাকা উচিৎ।
কেননা মানুষের শরীরের যে স্বাভাবিক ডিমের চাহিদা তা পূরণ হলে, মানুষের রোগ কম হতো। ওষুধের পরিমাণ কম লাগতো। এতে মানুষের স্বাস্থ্য ভালো থাকত। এ খাত আগে শুল্ক মুক্ত ছিল। এখন এই খাতের যন্ত্রাংশ আমদানির ওপর শুল্ক দিতে হয়। এই খাতের শুল্ক প্রত্যাহার জরুরি। কেননা শুল্ক প্রত্যাহার করলেই এই সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়বে। একই সঙ্গে দেশীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও ডিম রফতানি করা সম্ভব।
এমএ/একে/এমএস