হ্যাপী আখন্দ। আশির দশকের শুরুর দিকে যখন বাংলা গানের নতুন ধারা তৈরি হচ্ছে, সে সময় মূলধারার সঙ্গে নতুনের মিলমিশ ঘটিয়ে শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছিলেন এক প্রতিভাবান তরুণ। তিনিই হ্যাপী আখ্ন্দ। হৃদয়কাড়া কণ্ঠস্বরের অধিকারী ছিলেন। অসাধারণ গিটার বাজাতে পারতেন। পিয়ানোও বাজাতেন ভালো।
Advertisement
একজন গায়ক এবং সংগীত আয়োজক। তাকে বাংলাদেশি সংগীতের বরপুত্র বলা হত। কেউ কেউ তাকে বলেন বাংলা সংগীতের ট্র্যাজিক রাজপুত্র। তিনি আর ডি বর্মণ, আব্বাসউদ্দীন, মান্না দে, সমর দাশের মতো সংগীতজ্ঞের প্রশংসা আর স্নেহ অর্জন করেছিলেন নিজ যোগ্যতায়। আর সংগীতের আরেক কালপুরুষ লাকী আখন্দ ছিলেন তার বড় ভাই।
আজ এ ক্ষণজন্মা সংগীতপুরুষের জন্মদিন। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে তার কর্ম ও স্মৃতির প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা।
হ্যাপী আখন্দের জন্ম ১২ অক্টোবর, ১৯৬৩ সালে ঢাকার পাতলাখান লেনে। জন্মের সময় তার ভাই লাকী আখন্দ তার হাতে একটি পয়সা গুজে দিয়েছিলেন এবং প্রায় চার-পাঁচদিন পর তিনি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পরও তার হাতে গুজে দেয়া পয়সাটা ছিল। তার ছিল মানবিক বোধে সমৃদ্ধ এক হৃদয়। ছোটবেলায় ভাত খাওয়ার সময় তিনি কাক ডেকে ডেকে ভাত খাওয়াতেন।
Advertisement
তিনি কোন বিষয় সম্পর্কে একবার শুনলেই মুখস্থ করে ফেলতেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে তার হাতে গিটারের তাল ধরা দেয়। শুরুর দিকে হ্যাপী আখন্দ ভাই লাকী আখন্দের সাথে বিভিন্ন কনসার্টে অংশ নিতেন তবলা বাজানোর জন্য।
একটা সময় নিজেই ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’ নামে একটি ব্যান্ড গড়েছিলেন, সেখানে তিনি গিটার বাজানোর পাশাপাশি গানও গাইতেন। কলকাতার মধু মুখার্জি ছিলেন তার ছাত্র। ১৯৭৫ সালে ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটি লিখেছিলেন এসএম হেদায়েত এবং সুর করেছিলেন লাকী আখন্দ। এই গানটির সংগীত আয়োজন করে হ্যাপী আখন্দ বাংলাদেশ টেলিভিশনে গেয়েছিলেন। ১৯৭২ এর পর ২১ ফেব্রুয়ারি ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর এর মতো জাতীয় উৎসবগুলোতে গণসংগীতও পরিবেশন করতেন।
হ্যাপী আখন্দের গাওয়া জনপ্রিয় গান হলো, ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’, ‘কে বাঁশি বাজায় রে’, ‘খোলা আকাশের মতো তোমাকে হৃদয় দিয়েছি’, ‘নীল নীল শাড়ি পরে’, ‘পাহাড়ি ঝরনা’, ‘এই পৃথিবীর বুকে আসে যায়’, ‘স্বাধীনতা তোমায় নিয়ে গান তো লিখেছি’ ইত্যাদি।
তার সংগীতায়োজনে ফেরদৌস ওয়াহিদের গাওয়া ‘এমন একটা মা দে না’, প্রয়াত ফিরোজ সাঁইর গাওয়া ‘ইশকুল খুইলাছে রে মাওলা’ গানগুলো ওই সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তার বিখ্যাত গান ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটি ১৯৮০ সালে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকি পরিচালিত সুবর্ণা, আসাদ, তারিক আনাম অভিনীত ‘গুড্ডি’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়। গুড্ডি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনার পাশাপাশি হ্যাপী আখন্দ একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেন।
Advertisement
সংগীত পরিবারে জন্ম নেয়ার ফলে বাবা এবং বড় ভাই লাকী আখন্দের কাছ থেকে পেয়েছেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতজ্ঞান, আবেশী কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সঙ্গে গিটার, পিয়ানো, তবলাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর সহজাত দক্ষতায় বিস্মিত করেছিল সেই সময়ের শ্রোতা ও শিল্পীদের। গিটার, পিয়ানো, তবলা যা-ই বাজাতেন, এক অদ্ভুত ভালোলাগার জন্ম দিতে পারত তার সংগীত।
পৃথিবীর নানা ধাঁচের সংগীত শুনে শুনে ও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গুণী শিল্পীদের সান্নিধ্যে অর্জিত সংগীতের নানা জ্ঞান ও দর্শন অকাতরে বিলিয়ে দিতেন নিজের বন্ধুপ্রতিম সহশিল্পী আর ছাত্রদের মধ্যে। সেই সঙ্গে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে ও নতুনত্ব আনতে হ্যাপি তার উদ্ভাবনী শক্তিকে সব সময় কাজে লাগাতেন।
এমন মানুষকে আজ ভুলতে বসেছি আমরা। কোথাও নেই তিনি। কেউ কি তাঁকে মনে রেখেছে? তাকে নিয়ে কি কোথাও কোনো আলোচনা হয়? তার জন্ম ও মৃত্যু দিনগুলোও চলে যায় নিরবে নিভৃতে, আদরের অভাবে। তার মতো গুণীকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে পারছে না সংগীতাঙ্গণ; এটা বেদনার। কেবল শূন্যতা জানে সংগীতে তার শূন্যতা কতোটা শোকের। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন তিনি। দেখা তো হবেই আবার কোনো এক সন্ধ্যায়......
হ্যাপী আছেন ফিডব্যাকের গানে১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় ফিডব্যাকের বহুল জনপ্রিয় অ্যালবাম ‘মেলা’। ‘মেলা’, ‘মৌসুমি-পর্ব ২’, ‘গোধূলি’, ‘স্বদেশ’, ‘ময়ূরী আকাশ’, ‘জীবন জ্বালা’ কিংবা ‘জন্মেছি এই যুগে’-র মত শ্রোতাপ্রিয় গানের পাশাপাশি ‘পালকী’ শিরোনামে একটি গান সংকলিত হয়েছিল ‘মেলা’ অ্যালবামে। আহমেদ ইউসুফ সাবের ও মাকসুদুল হকের যৌথ রচনায় ‘পালকী’ গানটি ছিল ‘হ্যাপি আখন্দ’-র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ।
‘সেদিন ছিল ফিডব্যাকের শীতকালীন মহড়া।তারিখ ২৮-শে ডিসেম্বার, ১৯৮৭। এক হিমেল সন্ধ্যা।হঠাৎ একটি খবর চমকে দিল আমাদের।হ্যাপী নেই। থেমে গেল মহড়ার উচ্ছ্বাস।শিল্পীর মৃত্যু নেই।আমাদের বিশ্বাস হ্যাপী আখন্দের মৃত্যু নেই।তার এই চলে যাওয়া মৃত্যু যাত্রা নয়।অন্য সুরের ভুবনে বর বেশে এ যেন হ্যাপীর পালকী চড়ে মহাপ্রস্থান।কানে এখনো বাজে তার শেষ যাওয়ার সুর’।এই ভূমিকা দিয়েই শুরু হয়ে ফিডব্যাকের ‘পালকী’ গানটি। ভূমিকা শেষেই কণ্ঠে ভেসে আছে -
তাকে বলে দাও আমি সেদিনের কথা ভুলিনিতাকে বলে দাও সেই মণিহার আজও খুলিনিতাকে বলে দাও তারই কারণে এত যন্ত্রণাতাকে বলে দাও তারই বিহরে এত বেদনা ....’
হ্যাপীর চলে যাওয়ায় ফিডব্যাক ও মাকসুদুল হক ব্যথার তীব্র হাহাকার বুকে নিয়ে এভাবেই রচনা করেছেন বেদনা ও যন্ত্রণার কাব্য সঙ্গীত। আর সেই কাব্য সংগীতের পরতে পরতে আছে বন্ধু হারানোর বেদনা আর অস্ফুট যন্ত্রণা। সূত্র : অনলাইন
এলএ/পিআর