দীর্ঘ ৩২ বছর পর আবার এশিয়া কাপ হকি ফিরেছে ঢাকায়। এশিয়ার সেরা ৮ দলের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই দেখতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন হকিপ্রেমীরা। কেবল হকিপ্রেমীদেরই নয়, এ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের মানুষের নজর থাকবে লাল-সবুজ জার্সিধারী এক ঝাঁক তরুণের দিকে। আয়োজনের সাফল্যে তারাই আনতে পারবে পূর্ণতা। যেমন হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় এশিয়া কাপে।
Advertisement
এশিয়া কাপ হকি ফেডারেশন যেদিন ঢাকাকে দশম আসরের ভেন্যু করার সবুজ সঙ্কেত দিয়ে কিছু শর্ত জুড়ে দেয় সেদিন থেকেই আয়োজনের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের। ফ্লাডলাইট স্থাপন করতে হবে, ডিজিটাল স্কোর বোর্ড বসাতে হবে, প্রেসবক্স, ড্রেসিং রুম, সম্প্রচার কক্ষ, আম্পায়ার্স কক্ষসহ আরও কত কিছু আধুনিক করার তাগিদ।
এসব করতে গিয়ে আয়োজক বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের অবস্থা লেজে-গোবরে হলেও সময়মতো এশিয়ান হকি ফেডারেশনের সামনে আধুনিক এক হকি স্টেডিয়াম উপস্থাপন করতে পেরেছে বাংলাদেশ। অপেক্ষার পালা শেষ। আজই (বুধবার) মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের নীল টার্ফে এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লড়াইয়ে নামবে ৮ দেশ দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, জাপান, চীন, ওমান ও স্বাগতিক বাংলাদেশ।
৩২ বছর আগের এবং এবার এশিয়া কাপের পার্থক্য অনেক। ১৯৮৫ সালের টুর্নামেন্ট হয়েছিল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ঘাসের মাঠে। এবার হবে মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের নীল টার্ফে। বিশ্বের অনেক দেশ অনেক আগেই টার্ফের সঙ্গে পরিচিত হলেও বাংলাদেশের হকিপ্রেমীদের কাছে তা ছিল কল্পনার বাইরে। তবে বাংলাদেশের হকিও টার্ফের সঙ্গে পরিচয় নতুন নয়। এই তো মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামই দেখেছে দুটি টার্ফ। সবুজ টার্ফটিকে বিদায় দিয়ে দেশের একমাত্র হকি স্টেডিয়াম বুকে ধারণ করেছে নীল টার্ফ।
Advertisement
হকির নিয়ম-কানুনেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। টার্ফের ভুবনে প্রবেশ করার পর থেকে হকির আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিনিয়তই গবেষণা করছে নিয়মে আধুনিকতা আনতে। অফসাইড উঠিয়ে দেয়া, পেনাল্টি শুট আউটের প্রবর্তনসহ অসংখ্য পরিবর্তন এসেছে এ খেলাটির নিয়ম-কানুনে। সময়ের পরিবর্তনে স্টিকের জাদুও হয়েছে আরও মনোরম ও আকর্ষণীয়।
প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপ আয়োজন বাংলাদেশের হকির ওপর পড়েছিল বিশাল প্রভাব। ওই টুর্নামেন্টের পর হকির বিপ্লব ঘটেছিল লাল-সবুজের দেশে। গাছের ডাল কেটে স্টিক বানিয়ে যেখানে সেখানে খেলতে নেমে যেত কিশোর-তরুণরা। ঠিক যেমন এখন দেখা যায় ক্রিকেটে। হকির সে জাগরণটা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এক সময় হকিকে ধরা হতো ফুটবলের পরই দেশের জনপ্রিয় খেলা। ধীরে ধীরে বিশ্বে হকির জনপ্রিয়তা বাড়লেও বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলেছে স্বকীয়তা।
ঘরের মাঠের এ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ শক্তি আর সম্ভাবনায় পিছিয়ে সবার চেয়ে। র্যাংকিং বিবেচনায় আন্ডারডগ হয়েই টুর্নামেন্ট শুরু করবে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। কিন্তু কখনও কখনও র্যাংকিং আসল শক্তি মেলে ধরে না। মাঠের পারফরম্যান্স অনেক সময় র্যাংকিংকে উড়িয়ে দেয় তুরি মেরে। জিমিদের কাছে দেশের মানুষ সেটাই প্রত্যাশা করে।
হকি যতদিন শুধু ঘাসের মাঠের খেলা ছিল ততদিন দাপট ছিল ভারত-পাকিস্তানের। টার্ফের জগতে ঢোকায় এ দুই দেশের কাছ থেকে হকির শ্রেষ্ঠত্ব চলে যায় ইউরোপে। তবে এশিয়ায় এখনও পরাশক্তি হিসেবে টিকে আছে দক্ষিণ এশিয়ার এ দুই দেশ। যদি এশিয়ার সর্বশেষ দুই লড়াইয়ে বিজয়ের ঘোড়া ছুটিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। ঢাকার এশিয়া কাপে দক্ষিণ কোরিয়ায় শুরু করবে টপ ফেবারিট হিসেবে। তবে আবহাওয়া আর ভৌগোলিক দিকটা সমর্থন দেবে ভারত-পাকিস্তানকেও। বাংলাদেশের শক্তি ঘরের মাঠ আর পরিচিত দর্শক।
Advertisement
অতিথি সাত দেশের মধ্যে শক্তিতে বাংলাদেশের কাছাকাছি ছিল ওমান আর চীন। কিন্তু দুর্ভাগ্য স্বাগতিকদের এই দুই দেশ পড়েছে অন্য গ্রুপে। বাংলাদেশ পেয়েছে ভারত, পাকিস্তান আর জাপানকে। এ দেশ তিনটি শক্তিতে অনেক এগিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে। গ্রুপ পর্বে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো খেলা আর জাপানকে হারানোার টার্গেট নিয়েই বাংলাদেশ সব রণকৌশল সাজাচ্ছে।
হকি যারা বোঝেন এবং খেলাটির খোঁজখবর রাখেন তাদের কেউই জিমিদের কাছে বেশি চাইবেন না। তারা মনে করবেন না এ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন, রানার্সআপ হতে না পারলেও যেন তিন হয়। আসলে ৮ দেশের শক্তি বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের লক্ষ্য হওয়া উচিত নিজেদের ৮ নম্বর থেকে উপরে ওঠা। বাংলাদেশের প্রধান কোচ মাহবুব হারুন সে লক্ষ্যই নির্ধারণ করেছেন। ছয়ে চোখ রেখেই তিনি প্রস্তুত করেছেন জিমি-চয়নদের।
হকির টুর্নামেন্টের ফরম্যাট একটু আলাদা। গ্রুপ পর্বের ফলাফলই সব নয়। পরের স্থান নির্ধারণী ম্যাচগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। গ্রুপ পর্বে ভালো না করেও কোনো দল স্থান নির্ধারণী ম্যাচগুলোয় ভালো করে অবস্থানের উন্নতি ঘটাতে পারে। যে কারণে টুর্নামেন্টের ৬টি ম্যাচই গুরুত্বপূর্ণ।
গ্রুপ ঠিক হওয়ার পর থেকেই কোচ ওই ছয়ে রেখেছেন। তো ৬ নম্বরে থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করতে পারলে কী হবে? এশিয়া কাপ সরাসরি খেলে এশিয়ার র্যাংকিংয়ের শীর্ষ ছয় দেশ। বাকি দুই দেশ আসে বাছাই পর্ব খেলে। বাংলাদেশ ওই বাছাই পর্বটাই এড়াতে চাচ্ছে ৬ নম্বর হয়ে। ‘পরের এশিয়া কাপের বাছাই পর্ব এড়ানোর জন্য ৬ নম্বরে থাকার চেষ্টা করব আমরা’-প্রধান কোচ মাহবুব হারুন এক কথায় তার লক্ষ্যের কথা জানিয়েছেন।
গ্রুপ প্রসঙ্গে জিমিদের কোচ বলেছেন,‘গ্রুপটা অনেক কঠিন হয়েছে আমাদের। অন্য গ্রুপে পড়লে ভালো হতো। যদিও আমাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্থান নির্ধারণী ম্যাচগুলো। গ্রুপে তৃতীয় হতে পারলে স্থান নির্ধারণী ম্যাচটি পড়বে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের সঙ্গে। ‘বি’ গ্রুপে পড়লে ৩ নম্বর হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। এমন গ্রুপে পড়ায় লক্ষ্যটা একটু কঠিনই হয়েছে।’
বাংলাদেশকে টুর্নামেন্ট শুরু করতে হচ্ছে একটা বড় পরীক্ষা দিয়েই। সে পরীক্ষার নাম পাকিস্তান। এশিয়া কাপের সাবেক চ্যাম্পিয়ন দলটির বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ম্যাচে বাংলাদেশ কেমন খেলে তার ওপরই নির্ভর করছে দলের পরের ম্যাচগুলো দর্শক কতটা টানতে পারবে। হকি সংশ্লিষ্টদের ধারণা, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যদি লড়াই করতে পারে তাহলে এবারও দর্শকের ঢল নামবে মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে।
আরআই/আইএইচএস/আইআই