মতামত

ইতিহাস গড়তে পারেনি কাতালানরা

পার্লামেন্ট থেকে কাতালান জাতির স্বাধীনতার প্রশ্নে কেমন ঘোষণা আসবে -তা জানার অপেক্ষায় ছিল পুরো ইউরোপসহ বিশ্ব রাজনৈতিক। কাতালোনিয়া কেন্দ্রীক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পুরো ২ সপ্তাহ উৎকণ্ঠায় নিমজ্জিত ছিল পুরো স্পেন। কাতালানরা ভেবেছিলেন তাদের নেতা কার্লোস পুইজ দে মন্ট প্রায় ৩০০ বছরের হারানো স্বাধীনতাকে পুনরুদ্ধার করবেন। স্পেনের অঙ্গরাজ্য হয়ে থাকা কাতালোনিয়াকে স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি জাতিকে নিয়ে নতুন দেশ সন্নিবেশিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে সাথে সাথে আবার স্থগিত করলেন। যাদের সঙ্গে স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে মূল বিরোধ, সেই স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সংলাপের বসার সম্মতি জানিয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নে তারা রণে ভঙ্গ দিলেন।

Advertisement

ঘোষণার দিন কাতালোনিয়া পার্লামেন্টের সম্মুখে বড় টিভি সেট করা হয়। দিনভর কাতালোনিয়ার পতাকা হাতে হাজার হাজার মানুষ সেখানে জড়ো হয়। উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকার বাসনায়। অবশেষে প্রতীক্ষার অবশান ঘটিয়ে ঘড়ির কাটায় সন্ধ্যা ৬টা বাজলো। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পুইজ দে মন্ট কাতালোনিয়া পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু করার জন্য স্পিকারের কাছে আরও এক ঘণ্টা সময় চান। পরে সংসদের অধিবেশন ১ ঘণ্টা বিলম্বিত হয়ে সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হয়। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামীরা দিনভর তাদের আবেগ উজ্জীবিত রেখে বাড়তি একঘণ্টা প্রতীক্ষা করেও শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে পারেননি। প্রতিক্রিয়া স্বরূপ হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী কাতালানদের সেই সমাবেশ স্থলে মুহূর্তের মধ্যে চলে আসে পিন পতন নীরবতা। অনেকে আবার ক্ষোভে ফেটে পড়েন। মাথায় হাত দিয়ে বসেন। আশা ভঙ্গের হতাশা নিয়ে স্বাধীনতাকামীরা নতমস্তকে নীরব প্রস্থান করেন পার্লামেন্ট অঙ্গন থেকে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন কাতালানদের স্বাধীনতার পথে নিয়ে যাবার জন্য উজ্জীবিত করে আবার সেটাকে স্তিমিত করে দিলেন রাজনীতিকরা? উত্তর পেতে হলে রাজনীতির সমীকরণ করতে হবে এখানে। পৃথিবীর ইতিহাসে খুব সহজে কোনো জাতি স্বাধীনতা পেয়েছে এমন ঘটনা বিরল। সাম্প্রতিক সময়ে স্বাধীনতার প্রশ্নে কাতালান জাতি অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করেছে -এমন নজির নেই। বরং সাংবিধানিকভাবে কাতালানরা আলাদা জাতিসত্ত্বা স্বীকৃতি নিয়ে নিজেদের স্বায়ত্বশাসন সমুন্নত রেখে ভালোই আছে। শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হওয়াসহ যে ইস্যুগুলোর কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে তাদের বিরোধ সেটা এতটা সঙ্কটজনক নয় যে, একটা জাতিকে হঠাৎ করে স্বাধীনতার চূড়ান্ত পথে নিয়ে যাবে। তবে কাতালানরা কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে একটা সম্মিলিত আওয়াজ তোলার চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতা দাবি করার পেছনে যে কারণগুলো তারা দেখিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার যাতে সেগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয় সেই রকম এটা পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশও ছিল কাতালান নেতৃবৃন্দের।

গত সেপ্টেম্বর মাসে কাতালোনিয়ার পার্লামেন্টে কাতালানদের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য যে আইন পাশ করে, সেটাকে স্পেনের সাংবিধানিক আদালত চ্যালেঞ্জ করে। আইনটিকে অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন বন্ধ করতে নির্বাহী আদেশ দেন। পরে কেন্দ্রীয় সরকার ১ অক্টোবরের বিতর্কিত নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামীদের নজীরবিহীন সংঘর্ষের ঘটনায় প্রায় ৯০০ জন আহত হয়েছে। কাতালোনিয়া পার্লামেন্টে পাস হওয়া আইনটি অনুসারে ভোটে ফলাফলে স্বাধীনতার প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কাতালান পার্লামেন্ট স্বাধীনতা ঘোষণা করার কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু সেটা তারা করতে পারেনি। কারণ, স্পেন সরকার দেশটির সংবিধানের ১৫৫ ধারার ভয় দেখিয়ে স্বাধীনতাকামীদের শায়েস্তা করেছে। উক্ত ধারা অনুসারে কেন্দ্রীয় সংসদ চাইলে কাতালোনিয়ার স্বায়ত্বশাসন বাতিল করার আইন পাস করতে পারবে।

Advertisement

কাতালোনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করতে গিয়ে নিজেদের স্বায়ত্বশাসন খোয়ানোর মত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবে না সেটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার স্পষ্ট করে দিয়েছে, কাতালোনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ দেশদ্রোহীতার অভিযোগে গ্রেফতার হবেন।

এ ছাড়া স্বাধীনতা ঘোষণা হবার সম্ভাবনাকে সামনে রেখে ভোট অনুষ্ঠানের পর থেকে কাতালোনিয়া অবস্থিত প্রায় ২০টি বড় কোম্পানি কাতালোনিয়া থেকে তাদের কেন্দ্রীয় অফিস সরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। যেটা কাতালোনিয়ার সমৃদ্ধ অর্থনীতিতে একটা বড় অশনি সংকেত হয়ে আসছিল। নির্বাচনের পর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া সাক্ষাতকারে কাতালোনিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট আরতুর মাস (যিনি নিজেও স্বাধীনতাপন্হী) বলেন, কাতালোনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই এখনো প্রস্তুত নয়। এসব পরিস্থিতি বিচার করে কাতালান নেতৃবৃন্দ কাতালোনিয়ার প্রায় ৫০ লক্ষ স্বাধীনতাকামীর আবেগকে গুরুত্ব না দিয়ে বাস্তবতা মেনে নিয়েছে।

এ ক্ষেত্রে কাতালানরা শত শত বছর ধরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য করে আসা আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে সেটা ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করবে। তবে কাতালোনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা না করে, স্বাধীনতাকামীদের চোখে আবেগের জল ঝরালেও স্পেনসহ পুরো ইউরোপ ইউনিয়নকে একটি বড় রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে এটাই বড় সত্য।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক ই-মেইল: miron.nazmul@gmail.com

Advertisement

আরএস/আইআই