বিশেষ প্রতিবেদন

মোদির মুসলিম বিদ্বেষী নীতির শিকার রোহিঙ্গারা

অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। রামরু’র (রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। গবেষণা করছেন শরণার্থী ও অভিবাসীদের নিয়ে।

Advertisement

সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। ভারত ও চীনের আগ্রাসন নীতির সমালোচনা করে বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলা করতে হলে বিশ্ব সংস্থার মধ্যস্থতা জরুরি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নানা অব্যবস্থাপনা দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ মতামতও ব্যক্ত করেন এই বিশেষজ্ঞ।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। দুই পর্বের প্রথমটি আজ প্রকাশিত হলো।

জাগো নিউজ : শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করছেন। রোহিঙ্গা সঙ্কট কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?

Advertisement

ড. তাসনিম সিদ্দিকী : স্বল্পতম সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী সমস্যা হচ্ছে রোহিঙ্গা সঙ্কট। একেবারেই পরিকল্পিতভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে নিধনের জন্য মিয়ানমারে গণহত্যা চালান হয়েছে।

গণহত্যা থেকে বাঁচতে গত ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে। এটি একটি চরম মানবিক বিপর্যয়। রোহিঙ্গা সঙ্কট বিশ্বের জন্য বড় সমস্যা এবং বাংলাদেশের জন্য এ সঙ্কট মোকাবেলা করা এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত এত বড় চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশের জন্য কী কী চ্যালেঞ্জ হতে পারে বলে মনে করেন?

ড. তাসনিম সিদ্দিকী : রোহিঙ্গা সমস্যা শুধুই বাংলাদেশের নয়। আন্তর্জাতিকীকরণ করে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ কখনই এত সংখ্যক মানুষকে দীর্ঘ সময় ধরে আশ্রয় দিতে পারবে না। গোটা বিশ্বকে এর দায় নিতে হবে। বিশ্বকে এটি বোঝান- এটিই হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। রোহিঙ্গা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ত্রুটি হলে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় পড়বে।

Advertisement

জাগো নিউজ : বর্তমান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের বাঁচিয়ে রাখা। ত্রাণ ব্যবস্থাপনা কেমন দেখছেন?

ড. তাসনিম সিদ্দিকী : হ্যাঁ, সমন্বিত ত্রাণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই এখন বড় সমস্যা। আন্তঃমন্ত্রণালয়, আন্তঃএজেন্সি, বৈদেশিক দাতা সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে সমন্বয় করাই হচ্ছে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সবার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গাদের এখন বাঁচিয়ে রাখতে পারাই হচ্ছে সময়ের দাবি।

এ কারণে আমি মনে করি, ত্রাণ পরিকল্পনা গঠন করে সেভাবে এগিয়ে যেতে হবে। এগুলো সবই বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ।

মানুষের প্রতি দায়ের অভাব থেকে আরেকটি সমস্যা এখন দৃশ্যমান। যে নৌকার মাঝি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একজন রোহিঙ্গাকে এপারে এনে জীবন বাঁচাচ্ছেন, তিনিই আবার ওই রোহিঙ্গার কাছ থেকে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছেন। গহনাও তুলে দিতে হচ্ছে মাঝির হাতে। এর মানে দ্বিচারিতা নীতি নিয়েই রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন কেউ কেউ। এমনটি অন্যান্য ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়।

দ্বৈত ভূমিকার এ মানুষগুলোকে ম্যানেজ করাও চ্যালেঞ্জ। আপনি চাইবেন না রোহিঙ্গারা ওপারে থেকে মরুক। আবার এও চাইবেন না রোহিঙ্গারা এপারে এসে সব হারাক।

জাগো নিউজ : আপনি বিশ্বকে বোঝানোর কথা বললেন। বিশ্বের দুই পরাশক্তি ভারত ও চীন-ই তো ইন্ধন দিচ্ছে রোহিঙ্গা নিধনে। বিশ্বকে কীভাবে পাশে পাবে বাংলাদেশ?

ড. তাসনিম সিদ্দিকী : রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত ও চীনের ভূমিকা খুবই দুঃখজনক। ভৌগোলিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক রাজনীতি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরে একপ্রকার অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল। এখন খানিকটা উন্মুক্ত। এখন অনেকেই তার স্বার্থ নিয়ে আসবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, একটি অঞ্চলের মানুষকে উৎখাত করে স্বার্থ বজায় রাখতে হবে।

এখানে দুটি বিষয় কাজ করছে। জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে রোহিঙ্গা নিধনে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। আর অং সান সু চি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র হিসেবেই কাজ করছে।

আর ভারত ও চীনের স্বার্থ এখানে অর্থনৈতিক। তবে ভারতের শুধু অর্থনৈতিক স্বার্থই এখানে কাজ করছে না।

অশান্তি সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের মাধ্যমে তো স্বার্থ রক্ষা হয় না।

জাগো নিউজ : তাহলে ভারতের স্বার্থটা কোথায়?

ড. তাসনিম সিদ্দিকী : নরেন্দ্র মোদির মুসলিম বিদ্বেষী নীতির শিকার রোহিঙ্গারা। দক্ষিণ এশিয়ায় ঔপনিবেশিক যে কর্তৃত্ব দেখাতে চায় মোদি সরকার, এরই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি মিয়ানমারের আরাকানে। মোদি বাইরের দেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার ঘটাতে চান আবার ভোটের রাজনীতির কারণে নিজ দেশের মুসলমানদের পক্ষে অবস্থান নেন।

ভারত অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং ঔপনিবেশিক স্বার্থের কারণেই মিয়ানমার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়েছে।

অন্যদিকে চীন শুধুই অর্থনৈতিক কারণে রোহিঙ্গা নিধনে শরিক হচ্ছে। তারা কখনই মানবাধিকারের দিকে তাকায় না। শুধুই অর্থনৈতিক স্বার্থে চীনেও মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

জাগো নিউজ : চীন যদি মিয়ানমারের স্বার্থ দেখে, তাহলে এমন স্বার্থ বাংলাদেশেও আছে।

ড. তাসনিম সিদ্দিকী : এটিই প্রশ্ন। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। মিয়ানমার বোঝাতে পারল, আমরা কেন পারলাম না? রোহিঙ্গা সমস্যা তো দীর্ঘদিনের। আমরা কেন কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়নের মাধ্যমে চীনকে বোঝাতে সক্ষম হলাম না? আমরা বোঝাতে পারতাম, তোমার অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণেই আরাকানে শান্তি জরুরি। তুমি এভাবে অশান্তি সৃষ্টি করে লাভবান হতে পারবে না। এজন্য লাগাতারভাবে বোঝানোর ব্যাপার ছিল। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা চীনকে বোঝাতে পারিনি।

জাগো নিউজ : ১৯৭৮ সালে তো দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠান হলো। ওই সময় ভারত-চীন ছিল না।

ড. তাসনিম সিদ্দিকী : বাস্তবতা বদলে গেছে। বদলে গেছে ভৌগোলিক রাজনীতিও। এখন আর দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এমন সমস্যার সমাধান হয় না। কারণ স্বার্থ অন্যদেরও থাকে।

জাগো নিউজ : তার মানে চাপ প্রয়োগে যে শক্তির প্রয়োজন বাংলাদেশ প্রশ্নে তার ঘাটতি আছে?

ড. তাসনিম সিদ্দিকী : অবশ্যই। এতদিনে মিয়ানমার সামরিক দিক দিয়ে অনেক শক্তি অর্জন করেছে। সেই শক্তির পরীক্ষায় মিয়ানমার এক ধরনের খেলায় নামতে চায়।

এ খেলায় বাংলাদেশ কখনও ধরা দেবে না। দেয়া ঠিকও হবে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, মিয়ানমার উসকানি দিয়েছে।

বাংলাদেশ মিয়ানমারের ফাঁদে পা দিলে এ অঞ্চল অশান্ত হবে। এতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো লাভবান হবে। অস্ত্রের ব্যবসায় মেতে উঠবে চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র।

জাগো নিউজ : শরণার্থী সমস্যা সহসাই নিরসন হয়েছে, এমন নজির নেই। এমনকি বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সমস্যা আজও রয়ে গেছে।

ড. তাসনিম সিদ্দিকী : আটকে পড়া পাকিস্তানিদের বিষয়টি একটু আলাদা। রোহিঙ্গা সমস্যা যে দীর্ঘমেয়াদি, তা বলা যাচ্ছে না। আবার আশু কোনো সমাধানও দেখতে পাচ্ছি না।

মিয়ানমারের মন্ত্রী এসে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার কথা বলেছেন। তার কথায় আসলে আন্তরিকতা আছে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।

বহুপক্ষীয় চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। ১৯৯২ সালের যৌথ যে চুক্তি হয়েছিল, তার ভিত্তিতেও আলোচনা করা যেতে পারে। আলোচনার জন্য আমাদেরই এগিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপও অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এটি করা না গেলে সহজে কোনো সমাধান মিলবে না।

এএসএস/এমএআর/জেআইএম