অর্থনীতি

এনআরবি গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্সে ১০০ টাকার ব্যয় ১৩৫

মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করছে নতুন প্রজন্মের জীবন বীমা কোম্পানি এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স। প্রতিষ্ঠানটি বীমা পলিসি বিক্রি করে যে পরিমাণ অর্থ আয় করছে ব্যবস্থাপনা খাতেই ব্যয় করছে এর থেকে বেশি। এমনকী ১০০ টাকা প্রিমিয়াম করতে প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় করছে ১৩৫ টাকা।

Advertisement

অস্বাভাবিক এমন অর্থ ব্যয়ের কারণে কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয় পড়ছে। প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো উদ্বৃত্ত অর্থ থাকছে না। যে কারণে ব্যবসা শুরুর পর একে একে চার বছর পার হলেও লাইফ ফান্ড ঋণাত্মকই রয়ে গেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি থেকে বীমা পলিসি কেনা গ্রাহকদের অর্থ ফেরত পাওয়াও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ব্যবসা শুরুর তিন বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও চার বছরেও কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হতে পারেনি।

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছর ২০১৬ সালে এনআরবি গ্লোবাল লাইফ প্রিমিয়াম আয় করেছে চার কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করেছে পাঁচ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি যে আয় করেছে তার থেকে এক কোটি ৫৩ লাখ টাকা বেশি খরচ করেছে। অন্যভাবে বলা যায়, কোম্পানিটি ১০০ টাকা আয় করতে ব্যয় করেছে ১৩৫ টাকা।

শুধু ২০১৬ সাল নয় ব্যবসা শুরুর পর থেকেই জীবন বীমা কোম্পানিটি এমন অস্বাভাবিক অর্থ ব্যয় করছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যবসা সংগ্রহের ক্ষেত্রেও। ফলে গত তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এনআরবি গ্লোবাল লাইফের বীমা পলিসি বিক্রির মাধ্যমে প্রিমিয়াম আয় কমে গেছে।

Advertisement

ব্যবসা শুরুর প্রথম বছর ২০১৩ সালে কোম্পানিটি বীমা পলিসি বিক্রি করে প্রিমিয়াম আয় করে দুই কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যয় করে দুই কোটি ২৬ লাখ টাকা। পরের বছর ২০১৪ সালে ব্যবসা সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ব্যয়ের পরিমাণও। বছরটিতে প্রিমিয়াম বাবদ আয় হয় আট কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ব্যয় হয় ১০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।

ব্যবসা শুরুর দ্বিতীয় বছরে প্রিমিয়াম আয় বাড়লেও তৃতীয় বছরে অর্থাৎ ২০১৫ সালে ব্যবসায় ধস নামে। প্রিমিয়াম আয় আগের বছরের তুলনায় কমে অর্ধেকে চলে আসে। বছরটিতে প্রিমিয়াম আয় হয় পাঁচ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আয় কমলেও ছুটতে থাকে ব্যয়ের পাগলা ঘোড়া। আয়ের থেকে দুই কোটি ১৫ লাখ টাকা বেশি অর্থাৎ সাত কোটি ৭৫ লাখ টাকা খরচ করে কোম্পানিটি।

বীমা আইন অনুযায়ী, একটি জীবন বীমা কোম্পানির মোট প্রিমিয়াম আয় থেকে ব্যবস্থাপনা ব্যয় কোনো অবস্থায় বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ জীবন বীমা ব্যবসার অনুমতি পাওয়ার পর একটি প্রতিষ্ঠান তিন বছর পর্যন্ত প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের সাড়ে ৯৭ শতাংশ এবং নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের সাড়ে ২২ শতাংশ পর্যন্ত খরচ করতে পারে। ১৯৫৮ সালের বীমাবিধির ৩৯ ধারায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের এ নিয়ম বেধে দেয়া হয়েছে।

আইনে এমন বাধ্যবাধকতা থাকার পরও ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরছে না প্রতিষ্ঠানটি। ফলে কোম্পানিটির আর্থিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ছে। খরচ মেটাতে পরিশোধিত মূলধনের টাকা উত্তোলন করতে হচ্ছে। জীবন বীমা কোম্পানির প্রাণ হিসেবে পরিচিত লাইফ ফান্ডও ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির। ২০১৬ সাল শেষে এনআরবি গ্লোবাল লাইফের লাইফ ফান্ডের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক দুই কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

Advertisement

লাইফ ফান্ডের এ ঋণাত্মক ধারা বছরের ব্যবধানে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ব্যবসা শুরুর প্রথম বছর শেষে এনআরবি গ্লোবাল লাইফের লাইফ ফান্ড দাঁড়ায় ঋণাত্মক ১৫ লাখ টাকা। পরের বছর ২০১৪ সালে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় এক কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ২০১৫ সাল শেষে তা আরও বেড়ে হয় দুই কোটি ১৯ লাখ টাকা।

এদিকে বীমা কোম্পানিটি প্রতি বছর নতুন বীমা পলিসি বিক্রি করে যে অর্থ আয় করছে, তার সিংহভাগই পরবর্তী বছর আর নবায়নে আদায় হচ্ছে না। ২০১৩ সালে এনআরবি গ্লোবাল লাইফ নতুন পলিসি বিক্রি করে প্রিমিয়াম আয় করে দুই কোটি টাকা। পরের বছর নবায়নে যার মাত্র চার দশমিক ৮৫ শতাংশ বা নয় লাখ ৭০ হাজার টাকা আদায় হয়।

একই ভাবে ২০১৪ সালে নতুন বীমা পলিসি বিক্রি করে আয় হয় আট কোটি পাঁচ লাখ টাকা। আর ২০১৫ সালে নবায়ন প্রিমিয়াম বাবদ আয় হয় মাত্র সাত দশমিক ৬৪ শতাংশ অর্থাৎ ৬১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০১৫ সালে নতুন পলিসি বিক্রি করে আয় হয় চার কোটি ৮৮ লাখ টাকা, পরের বছর ২০১৬ সালে নবায়নে যার ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ অর্থাৎ ৮৫ লাখ ৫৮ হাজার টাকা আদায় হয়। অর্থাৎ কোম্পানিটির বিক্রি করা বীমা পলিসির টাকার ৮০ শতাংশের ওপরে পরবর্তীতে আর নবায়নে আদায় হচ্ছে না।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে প্রতিষ্ঠানটির দাখিল করা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে নতুন বীমা পলিসি বিক্রি হয় ৯৬৩টি। ২০১৪ সালে এ পলিসিগুলোর মধ্যে ৯৩৫টি পলিসি তামাদি বা বন্ধ হয়ে যায়। পরের বছর ২০১৪ সালে পাঁচ হাজার ৭৪৭টি পলিসি বিক্রি হয় এবং ২০১৫ সালে তামাদি হয় পাঁচ হাজার ৬২৫টি পলিসি। একইভাবে ২০১৫ সালে তিন হাজার ৪০০টি পলিসি বিক্রির পর ২০১৬ সালে পলিসি তামাদি হয় দুই হাজার ৯৩৬টি।

এ প্রসঙ্গে এনআরবি গ্লোবাল লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামরুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। কারণ আমি এ কোম্পানিতে থাকছি না।

কী কারণে কোম্পানি ছেড়ে দেবেন সে বিষয়েও কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।

এমএএস/এমএআর/আরআইপি