পচেফস্ট্রমে রান পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ার পর ব্লুমফন্টেইনেও যে বাংলাদেশ ইনিংস পরাজয়ের লজ্জায় ডুবতে যাচ্ছে, তা দ্বিতীয় দিন শেষেই বোঝা যাচ্ছিল। অতিবড় বাংলাদেশ ভক্তও ধরে নিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টেও করুণভাবে হারতে যাচ্ছে প্রিয় জাতীয় দল। বাংলাদেশের পরাজয় নিশ্চিত ভেবে ও ধরেই গতকাল (রোববার) খেলা দেখতে বসেছিলেন বাংলাদেশ সমর্থকরা।
Advertisement
তবে বাংলাদেশ দলের পরিণতি নিয়ে উৎসাহ ও আগ্রহের চেয়ে বরং অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমের বিষয়েই সবার কৌতুহল ছিল বেশি। অনেক ঘটনা, রটনা এবং আনুসাঙ্গিক বিষয় চলে গিয়েছিল মুশফিকুর রহীমের প্রতিকূলে। পর পর দুই টেস্টে টস জিতে ব্যাটিং না নিয়ে ফিল্ডিং করা, প্রেস কনফারেন্সে নিজ দলের বোলারদের কঠোর ভাষায় সমালোচনা করা এবং টিম ম্যানেজমেন্ট তাকে সীমানার ধারে ফিল্ডিং করতে বলেছে, এ সব কথা বার্তা বলে মুশফিক নিজের অবস্থানকে অনেকটাই হালকা করে ফেলেছিলেন।
অবস্থা এমন হয়ে যায় যে, বাংলাদেশ দলের চরম দুর্বল ও ধারহীন বোলিং, আত্ববিশ্বাস ও আস্থাহীন এবং শ্রীহীন ব্যাটিং ছাপিয়ে মুশফিকের পর পর দুই টেস্টে টস জিতে আগে ফিল্ডিং করার ইস্যু বড় হয়ে দেখা দেয়। কারো কারো মত, টস জিতে ব্যাটিং না করে ফিল্ডিং বেছে নেয়ায় বাংলাদেশের বিপর্যয় আরও ঘনীভূত হয়েছে। আগে ব্যাটিং করলে এতটা বাজে ও করুণ পরিণতি নাও হতে পারতো। এতে হঠাৎ রীতিমত ‘খলনায়ক ’ বনে যান বাংলাদেশ টেস্ট অধিনায়ক।
একে তো দল খারাপ খেলেছে, একজন ব্যাটসম্যানের ব্যাট কথা বলেনি। কেউ সেঞ্চুরি দূরে থাকি, দুই টেস্টের চার ইনিংসে এক মুমিনুলের একটি ফিফটি ( প্রথম ইনিংসে ৭৭) ছাড়া আর কেউ পঞ্চাশের ঘরে যেতে পারেননি। দুই টেস্টে একজন বোলার এক ইনিংসে ৫ উইকেটের পতন ঘটাতে পারেননি। কোন সমীহ জাগানো স্পেলও নেই।
Advertisement
সহযোগীদের কাছ থেকে এতটুকু উজ্জ্বল ও কার্যকর পারফমেন্স না পাওয়ায় মুশফিক আরও চুপসে যান। তার শরীরি অভিব্যক্তি, কথা-বার্তা, দল পরিচালনা, বোলারদের ব্যবহার ও ব্যাটিং দেখে মনেই হচ্ছিল একটা অস্বাভাবিকতা বিরাজ করছে তার মনে। অধিনায়কের আচরণ, কথা-বার্তা ও কিছু সিদ্ধান্ত ( যদিও তা শুধুই তার একার নয়, টিম ম্যানেজমেন্ট মানে কোচের মতামত নিয়ে করা) নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড প্রধান নাজমুল হাসান পাপনও অসন্তোষ প্রকাশ করে বসেন।
দ্বিতীয় টেস্ট শুরুর দিন টেলিভিশনগুলোর সঙ্গে সাক্ষাতে বিসিবি বিগ বস বলেই ফেলেন, প্রথম টেস্টের মত দ্বিতীয় টেস্টেও কেন মুশফিক টস জিতে ফিল্ডিং করলো? তা বোধোগম্য হচ্ছে না। সবকিছু মিলে মনে হচ্ছিল ব্লুমফন্টেইন টেস্টই হয়তো অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমের শেষ ম্যাচ। সম্ভবত এ ম্যাচের মধ্য দিয়ে ইতি ঘটবে টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকের ক্যারিয়ার।
দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ কভার করতে যাওয়া কোন কোন প্রতিবেদকের লেখায় এমন আভাস ও ইঙ্গিত মিলে ছিল। হাব ভাবে মনে হচ্ছিল, ব্লুমফন্টেইন টেস্টের পর হয়তো মুশফিক নিজ থেকে অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেবেন, না হয় বোর্ডই তাকে অব্যাহতি দিবে। খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তাৎক্ষণিক কথোপকোথন আর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে পরাজয়ের কারণ নিয়ে অধিনায়কের ব্যাখ্যা শোনার চেয়ে ভক্ত-সমর্থক ও অনুরাগীদের বড় অংশ উন্মুখ হয়েছিলেন মুশফিক পদত্যাগের ঘোষণা দেন কি না?
ব্যাট হাতে লড়াকু, সংগ্রামী মুশফিক ব্যক্তি জীবনে খানিক আবেকপ্রবন ও কোমল স্বভাবের। বিভিন্ন সময় আবেগপ্রবন হয়ে ড্রেসিং রুমে কান্না করার রেকর্ড আছে তার। এ রকম অবস্থায় মুশফিক শেষ পর্যন্ত হয়তো অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে বসবেন, এমন মনে হলেও শেষ পর্যন্ত ঐ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
Advertisement
মুশফিক নিজে থেকে অধিনায়কত্ব ছাড়ার কোনই ঘোষণা দেননি। উল্টো পুরো বিষয়টি বোর্ডের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। রোববার ব্লুমফন্টেইন টেস্ট শেষে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলতে গিয়ে মুশফিক অধিনায়কত্ব প্রসঙ্গে অনেক কথা বলেন। যার সারমর্ম হলো আমি যেচে অধিনায়কত্ব ছাড়ব না। বিষয়টা নিতান্তই বিসিবির। বোর্ডই আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে। তারাই সিদ্ধান্ত নিবে আমাকে রাখবে রাখবে কি না?
তার মানে, এখনই অধিনায়কত্ব ছাড়ার কোনই ইচ্ছে নেই মুশফিকের। এটা তো মুশফিকের ভাবনা, চিন্তা ও উপলব্ধি। বোর্ড কি ভাবছে? বিসিবি কি মুশফিককে সড়িয়ে দিতে চাচ্ছে? দর্শক, ভক্ত ও সমর্থকরা তা জানতে উন্মুখ হয়ে আছেন। তাদের জন্য খবর, বিসিবি এখনই মুশফিককে পাল্টে নতুন কাউকে অধিনায়ক করার কথা ভাবছে না। এক কথায় মুশফিক ইস্যুতে বিসিবি ‘ধীরে চল নীতি’ অবলম্বন করছে।
অধিনায়ক নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় দল পরিচালনা ও পর্যালোচনার সমুদয় দায়িত্ব যে স্ট্যান্ডিং কমিটির, সে ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান আকরাম খান জাগো নিউজকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ‘মুশফিক ইস্যুতে এখনই কোন রকম চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভাবছি না। এ বিষয়ে কোন চূড়ান্ত মন্তেব্যর সময় এখন আসেনি।’
বর্তমানে নিজ শহর চট্টগ্রামে অবস্থানরত আকরাম খান আজ (সোমবার) সকালে জাগো নিউজের সঙ্গে মুঠোফোন আলাপে বলেন, ‘সাধারণত আমরা কোন সিরিজের আগে না হয় পরে কথা বলি। সিরিজের মাঝখানে কোন কিছু নিয়ে আলাপ করি না। তাতে প্লেয়ারদের পারফরমেন্সের ওপর প্রভাব ফেলে। ’
তবে ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটি চেয়ারম্যান মনে করেন মুশফিক যে সব কথা বার্তা আনুষ্ঠানিক সংবাদ সন্মলনে বলেছে, তা বলা ঠিক হয়নি। এতে করে দলের অভ্যন্তরীণ নিয়ম, শৃঙ্খলা ব্যাহত হতে পারে এমন চিন্তায় আকরাম বলেন, ‘অধিনায়ক হিসেবে মুশফিকের কোন প্রবলেম হলে তা আমাদের (বোর্ডকে) আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো ভাল ছিল। কিন্তু তা না করে মুশফিক মিডিয়ায় বলছে। অবশ্য মুশফিক যে অভিযোগ করেছে, তা এখনো আমি শুনিনি। আমার কাছে এমন কোন খবর নেই। তারপরও তার কথাগুলো প্রেস মিটে না বলে আমাদের বললে ভাল করতো। তখন আমরা এটা নিয়ে আলাপ আলোচনা করতাম।’
অনেক গুঞ্জন ছড়িয়ে গেছে মুশফিক আর অধিনায়ক থাকবেন না, কিংবা তাকে সড়িয়ে দেয়া হবে, এ প্রসঙ্গে কিছু বলতে বলা হলে আকরাম জাগো নিউজকে জানান, ‘বোর্ড এ রকম কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। আমাদের মধ্যে এসব নিয়ে কোন কথাই হয়নি। ইটস টু আর্লি টু সে।’
তবে আকরাম খান সবশেষে আরও একটা কথা বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শেষে পুরো সিরিজ নিয়ে বোর্ডে কথা হবে। পারফরমেন্স ও আনুসাঙ্গিক বিষয় খুটিয়ে দেখা হবে। তখনই হয়তো মুশফিক ইস্যু নিয়েও চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। কে জানে, ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হোম সিরিজে নতুন কাউকে অধিনায়ক হিসেবে দেখাও যেতে পারে।
এআরবি/এমআর/জেআইএম