ভ্রমণ

পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : সপ্তম পর্ব

১৫ ফেব্রুয়ারি। আজকের পথটা কম। তাই ঘুম থেকে একটু দেরি করেই উঠলাম। কেয়ারটেকার এসে আমার খোঁজ-খবর নিয়ে গেলেন। তার নাম আ. রহিম। তিনি জানালেন, সকালের খাবার চেয়ারম্যান তার বাড়িতে ব্যবস্থা করেছেন। তাই রেডি হয়ে আমি ও রহিম এলাকার চেয়ারম্যানের বাড়ি চলে গেলাম। বাড়ির সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। বিশেষ করে বাড়ির নারীরা। তারা আমার কথা শুনে আমাকে দেখতে চেয়েছেন। আমার জন্য অনেক ধরনের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। সবাই একত্রে বসে সকালের নাস্তা করলাম।

Advertisement

সকালে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার কথা ছিলো। পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। ফোসকা পরে ঘাঁ হয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে খুব কষ্ট হয়। এখনো চিকিৎসক আসেননি। আর আমার তার জন্য অপেক্ষা করার সময়ও নেই। তাই দেরি না করে হাঁটা শুরু করলাম। মেইন রোড থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ ভেতরে ছিলাম। এই পথ আমার বেশি হাঁটতে হচ্ছে। আজ রোদ আছে বলে শীতও কম। রাস্তাটার সৌন্দর্য় বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। এতো সুন্দর লাগছে। দু’পাশে খেজুর গাছের সারি। দিনের শুরুটা বেশ ভালোই লাগছে।

আমার ক্যামেরা যেহেতু নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করে; সেহেতু আজ মনে হলো ক্যামেরার মন ভালো। তাই আজ ছবি তুলতে পারছি। দূর থেকেই দেখতে পেলাম, কয়েকজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে। তারা হয়তো কোন স্কুল অথবা কলেজের ছাত্রী হবে। তাদের পোশাক দেখে তা-ই মনে হচ্ছে। তবে তারা যে আমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে সেটা বুঝতে পারলাম তাদের আচরণ দেখে। আমি কাছে যেতেই তারা হেসে উঠলেন। কেন হাসলেন বুঝলাম না। একবার ভেবেছিলাম জিজ্ঞেস করি। পরে ভাবলাম, প্রত্যেক মানুষের হাসার স্বাধীনতা আছে। তারা হাসতেই পারে। তাই আর জিজ্ঞেস করলাম না।

আরও পড়ুন- পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : প্রথম পর্ব

Advertisement

আমি তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলাম। পারলাম না। তারা আমাকে থামালো। তারা বললো, আমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মনের কৌতূহলগুলো প্রথমেই ভেঙে দিলাম। তারাও খুবই আগ্রহী হলো আমার কাজে। তাই তারাও নাকি যশোর রোড পর্যন্ত আমার সাথে হেঁটে যাবে। আমি জানতে চাইলাম, আমার সাথে এখন হাঁটলে তাদের ক্লাস মিস হবে কি না? তারা বললো, ‘ক্লাস মিস হবে না। তবে প্রাইভেট পড়া মিস হবে।’ তবুও হাঁটবে। তাদের কথা থেকেই জানতে পারলাম, আমাকে দেখে হাসার কারণটি। তাদের ভাবনা ছিলো এমন, ছোট্ট একটা মানুষ হেঁটে আসছে, গায়ে হলুদ জামা, শীতের মধ্যে শর্ট প্যান্ট পরা, মানুষটির থেকে তার কাঁধের ব্যাগটি বড়, বুড়ো মানুষের মতো হাতে লাঠি আবার ক্যামেরা দিয়ে ছবিও তুলছে। এই এতো সব বিষয়ের কারণে অদ্ভুত মানুষ ভেবেছিলো। তারা এমন মানুষ কখনো দেখেনি। তাই কিছুুটা কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তারা। প্রথমে ভেবেছিলো, হয়তো কোন পাগল কেউ হবে।

হাঁটতে হাঁটতে তাদের সাথে শেয়ার করলাম আমার এই দীর্ঘ পথ হাঁটার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আমরা বায়ান্ন দেখিনি, আমরা একাত্তর দেখিনি। আমাদের দেশের জন্ম হয়েছে কতো মানুষে ত্যাগের বিনিময়ে। আমরা আমাদের এই ইতিহাস কতটুকু জানি। জানি না, জানতে চেষ্টাও করি না। আমরা দেশকে ভালোবাসি। তবে যাদের কারণে এই দেশ পেলাম; তাদের সম্পর্কে যদি না জানি। তাদেরকে যদি মূল্যায়ন না করি তাহলে দেশকে ভালোবাসা হবে কী করে? তাই দেশকে ভালোবাসার আগে বায়ান্ন-একাত্তরের চেতনা বুকে ধারণ করে দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে।

যশোর নড়াইল রোডে চলে এলাম। ‘জামদিয়া দত্তরাস্তা মোড়’ নামে পরিচিত এই জায়গা। এখান থেকে মেয়েগুলো চলে গেলো তাদের কলেজে। আর আমি নড়াইলের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। সাথে যখন কেউ থাকে কথায় কথায় হাঁটলে ক্লান্তি ও কষ্ট বোঝা যায় না। একা হয়ে গেলেই ক্লান্তি, কষ্ট ও রাস্তার দূরত্ব বেড়ে যায়। কিছু সময় হাঁটার পর ছোট একটি চায়ের দোকান পেলাম। এখানে বসে চা বিস্কুট খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তার দু’পাশে বিস্তীর্ণ ডাল আর সরষে ক্ষেত। যতদূর চোখ যায় কৃষি জমি। কৃষকরা কাজ করছেন। ক্ষেতের মাঝে মাঝে বড় বড় তালগাছ। দেখতে খুব সুন্দর লাগছে।

পুরনো একটি ছোট ব্রিজ ভেঙে পড়ে আছে। পাশ দিয়ে বিকল্প রাস্তা করা হয়েছে। সেখান দিয়ে দিন-রাত যানবাহন চলাচল করছে। তবে এখনো কোন কাজের নাম নেই। এই ভোগান্তির শেষ কবে কে জানে? এই ব্রিজের এখানে পরিচয় হলো একজন শিক্ষকের সাথে। তিনি স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি সাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। তিনি আমার এই কাজে খুবই খুশি। তাই তিনি আবদার করলেন যেন তার স্কুলে যাই। তার ছাত্রছাত্রীদের সাথে একটু দেখা করি। তার বিদ্যালয়টি রাস্তার পাশেই। দুই-তিন মিনিট ভেতরে যেতে হবে। তাই আমিও রাজি হয়ে গেলাম।

Advertisement

স্কুলের অফিসে নিয়ে আমাকে শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রধান শিক্ষক বেশ সহজ-সরল মানুষ। তিনি আমাকে অনেক উৎসাহিত করলেন। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ডেকে একত্র করলেন। সেখানে আমাকে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে দেখছে। আবার আমাকে দেখে অনেকে মুখ লুকিয়ে লুকিয়ে হাসছে। তাদের সাথেও অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। একটি ছোট মেয়ে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার পাও বিষ করে না?’ আমি বললাম, ‘হুম, করে। দেখবে আমার পায়ের কী অবস্থা?’ সে দেখতে চাইলো। আমিও আগ্রহ নিয়ে জুতো খুলে দেখালাম। আমার পায়ের অবস্থা দেখে সবাই অবাক হলো। তাদের প্রশ্ন ছিলো, পায়ে এতো ফোসকা নিয়ে আমি হাঁটি কিভাবে?

আরও পড়ুন- পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : ষষ্ঠ পর্ব

তুলারামপুর বাজারে চলে এলাম। এখানে এসে পরিচয় হলো তুলারামপুর ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে। দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা তিনিই করলেন। খাবার শেষে আবার নড়াইলের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। বৃষ্টি হবে হবে করেও হচ্ছে না। মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি চলছে। এটা অবশ্য আমার জন্য ভালো। বেশি রোদে হাঁটতে কষ্ট হয়, আবার বৃষ্টি হলে তো হাঁটাই মুশকিল হবে। নড়াইল থেকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মলয় কুমার কুণ্ড ফোন করলেন। আমি কোথায় আছি? আসতে কত সময় লাগতে পারে? তারা আমার জন্য অপেক্ষা করছে- এসব নিয়ে কথা হলো। যদিও সকাল বেলা সবুর নামের এক ভদ্রলোক নড়াইল থেকে আমার সাথে ফোনে কথা বলেছেন। তিনিও বলেছিলেন, আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

বিকেল সাড়ে চারটার দিকে নড়াইল পৌঁছাই। এখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মলয় কুমার কুণ্ডসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও গণমাধ্যমকর্মী। এখানেও ফুলেল শুভেচ্ছা জানান তারা। উৎসুক জনতা ভিড় জমায়। এখানে আমার থাকার ব্যবস্থা করে নড়াইল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট তাদের নিজেস্ব অফিসে। অফিসের একটি রুমের মেঝেতে বিছানা করা হয়। প্রথমে গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে সাক্ষাৎ শেষ করি। তারপর ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম। বিশ্রামের মাঝেই খাবার চলে আসে। সন্ধ্যার পর নড়াইল টেলিফোন শিল্পের কর্মকর্তা সবুর সাহেব এসে আমাকে নিয়ে বের হন। আমার পায়ের ফোসকাগুলো প্রায় ঘাঁঁ হয়ে গেছে। ভালোভাবে হাঁটতে পারছি না। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছি। খুবই যন্ত্রণা হচ্ছে। শরীরটাও ব্যথায় টনটন করছে। সেই কলকাতা থেকে জুতো পরে হাঁটছি। তাই সবুর সাহেব আমাকে একজোড়া স্যান্ডেল কিনে দেন। আজ স্যান্ডেল পরে বেশ আরাম বোধ করছি।

এসইউ/জেআইএম