খেলাধুলা

‘বলির পাঠা’ হয়েই বিদায় অধিনায়ক মুশফিকের?

ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব হাতছাড়া হয়েছে অনেক আগেই। সেই ২০১৩ সাল থেকে তিনি শুধুই বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক। এবার কি টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম উপাখ্যানও শেষ হতে যাচ্ছে? ব্লুমফন্টেইন টেস্টই কি অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমের শেষ ম্যাচ?

Advertisement

এমন গুঞ্জন এখন চারদিকে। ‘আমি আর অধিনায়ক থাকব না। দল পরিচালনা থেকে সড়ে দাঁড়াব' মুশফিক নিজে মুখ ফুটে এমন কথা বলেননি। বোর্ড থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়ার কোনো আগাম ঘোষণা আসেনি। তবে পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে তাই মনে হচ্ছে। অনেকেরই ধারণা, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চলতি সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট ম্যাচের মধ্যে দিয়েই হয়তো অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমের অধিনায়ক ক্যারিয়ারের ইতি ঘটতে যাচ্ছে।

এটাকে শুধু গুঞ্জন আর জল্পনা-কল্পনা ভাবার সুযোগ নেই। চালচ্চিত্র এমন হয়েছে যে, মুশফিক নিজেই সম্ভবত দল পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সড়ে দাঁড়াবেন। না হয় বোর্ডই তাকে হয়তো দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেবেন।

গত কয়েক দিনের দৃশ্যপট পাখির চোখে পরখ করলে এমন সত্যই চোখের সামনে ভেসে উঠবে। পরপর দুই টেস্টে টস জিতে ফিল্ডিং বেছে নিয়ে করুণ পরিণতির মুখে পড়াই সবচেয়ে বড় কাল হয়েছে। এতে করে সবাই মুশফিককে ‘ভিলেনের’ আসনে বসিয়ে ফেলেছেন। চারদিকে সমালোচনার ঝড়। নিন্দা ও ক্ষোভের আগুন জ্বলছে গোটা দেশে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাংলাদেশের করুণ পরিণতির প্রায় সব দায়-দায়িত্ব এসে বর্তেছে মুশফিকের কাঁধে।

Advertisement

সবার কথার তীর মুশফিকের দিকে। ভাবটা এমন, মুশফিক কেন পর পর দুই টেস্টে টস জিতে আগে ব্যাট না করে ফিল্ডিং বেছে নিলেন? আগে ব্যাটিং করলে হয়তো এত করুণ পরিণতি ঘটত না। খোদ বোর্ড সভাপতিও দ্বিতীয় টেস্টে টস জিতে ব্যাটিং না করে ফিল্ডিং বেছে নেয়ায় মুশফিকের তীব্র সমালোচনা করেছেন।

টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সঙ্গে আলাপে বিসিবি বিগ বস নাজমুল হাসান পাপন প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘আমি বুঝতেই পারলাম না কেন মুশফিক দ্বিতীয়বার একই ভুল করল? প্রথম টেস্টে টস জিতে ব্যাটিং না করা যে ভুল ছিল, তা সবাই বুঝেছেন। তারপর দ্বিতীয় টেস্টেও কেন টস জিতে আবার বোলিংয়ে নামা? বোধগম্য হচ্ছে না আমার।’ বোর্ড সভাপতির এমন মন্তব্যই বলে দেয় অধিনায়ক মুশফিক রীতিমতো ‘কাঠগড়ায়।’

এখানেই শেষ নয়, ব্লুমফন্টেইন টেস্টের প্রথমদিন অনেকটা রীতি ভেঙে প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে কথা বলতে এসে মুশফিক বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন, যা তার অবস্থানকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। সংবাদ সম্মেলনে সাধারণত অধিনায়করা নিজ দলের বোলার ও ব্যাটসম্যানদের পক্ষে অবস্থান নেন, তাদের ভুলত্রুটি পাশ কাটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন।

কিন্তু গত শুক্রবার মুশফিক তার বিপরীত কাজ করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে নিজ দলের বোলারদের কঠোর সমালোচনা করেছেন, যা তাকে আরও বিতর্কিত করে তুলেছে। সব মিলে টিম বাংলাদেশের মতো অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমও চরম বেকায়দায়। এ অবস্থা থেকে সামনে আসা কঠিন।

Advertisement

এখন মুশফিকুর রহীমের রক্ষাকবচ শুধুই তার ব্যাট। আজ তৃতীয় দিন দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে মাথা তুলে দাঁড়ানো ছাড়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমের বাঁচার আর কোনো পথ নেই।

মুশফিক কি তা পারবেন? পারবেন এমন নিশ্চয়তাও যেমন নেই, আবার পারবেন না; তা বলাও কঠিন। ইতিহাস ও পরিসংখ্যান জানাচ্ছে মুশফিক পারেন। তার দল পরিচালনা, নেতৃত্ব ক্ষমতা আর সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা কথা থাকলেও ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহীমকে নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। থাকার প্রশ্নই আসে না। টেস্টে মুশফিক বাংলাদেশের অন্যতম সেরা উইলোবাজ। দলের অন্যতম সেরা ব্যাটিং স্তম্ভ। একজন শুদ্ধ গাণিতিক ও পরিপূর্ণ ব্যাটসম্যান মুশফিক। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যাকরণসম্মত ব্যাটসম্যান। তার মতো ক্রিকেট ব্যাকরণ মেনে, ধৈর্য ধরে আর ঠান্ডা মাথায় পরিবেশ-পরিস্থিতি ঠাউরে ব্যাট করেন না কেউই।

পরিসংখ্যানও তাই জানাচ্ছে। টেস্টে তামিম ইকবাল (৩৮৮৬) ও সাকিব আল হাসানের (৩৫৯৪) পরে রান তোলায় তিন নম্বরে মুশফিক (৩৪৯০)। বাংলাদেশের মাত্র তিনজন ডাবল সেঞ্চুরিয়ানের প্রথম সদস্যও মুশফিক। ২০০৫ সালের ২৬ মে লর্ডসে অভিষেকের পর ছয় নম্বর ইনিংসে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে প্রায় সেঞ্চুরি করে ফেলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ২০ রান পিছনে গিয়ে থামেন।

টেস্টে শতরানের দেখা পেতে লেগে যায় পাঁচ বছর। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের সঙ্গে প্রথম শতক ১০১ (২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি)। তারপর শুরু হয় ব্যাটসম্যান মুশফিকের অগ্রযাত্রা। ২০১৩ সালের মার্চে গলে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ডাবল সেঞ্চুরির পর থেকে টেস্টে বাংলাদেশের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান বনে গেছেন মুশফিক। গত চার বছরে ২১ টেস্টে আরও তিন সেঞ্চুরিসহ ১২ বার ৫০ ও তার বেশি রান এসেছে তার ব্যাট থেকে।

সবচেয়ে বড় কথা তিনটি সেঞ্চুরিই দেশের বাইরে। যার প্রথমটি ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে কিংস্টাউনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে (১১৬)। আর দুটি এ বছর; ২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৫৯ ও ফেব্রুয়ারি হায়দরাবাদে ভারতের বিরুদ্ধে ১২৭।

এ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার ব্যাট থেকে রানের ফোয়ারা বইছে। টেস্টে সর্বাধিক পাঁচ রান সংগ্রহকারীর একজন মুশফিক। কিন্তু অধিনায়ক মুশফিকের ক্যারিয়ার রক্ষায় শেষ পর্যন্ত হয়তো এর কোনোটাই কাজে আসবে না। ধরেই নেয়া যায় রোববার ব্লুমফন্টেইনে বড় সড় ইনিংস খেলতে না পারলে শেষ হয়ে যাচ্ছে অধিনায়ক মুশফিকের ক্যারিয়ার।

মুশফিক নানা কারণেই চাপে। তার অধিনায়কত্ব, সিদ্ধান্ত, দল পরিচালনা আর কথাবার্তা- সবই প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু গল্পের পেছনে যেমন কথা থেকে যায়, মুশফিকের বিতর্কিত হয়ে ওঠার পিছনেও কিন্তু আরও কাহিনি আছে। যেখানে হাথুরুসিংহে নামের একজনের ভূমিকাও কিছু কম নয়। যে সিদ্ধান্তের কারণে মুশফিক রীতিমতো ভিলেন বনে গেছেন, সেই পর পর দুই টেস্টে টস জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত কি মুশফিকের একার?

ক্রিকেটীয় নিয়ম, নীতি ও সংস্কৃতি মানলে সিদ্ধান্তটা একান্তই তার হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ জাতীয় দলের বর্তমান যে হাল হকিকত, তাতে অত বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই অধিনায়কের। কাজেই জোর দিয়েই বলে ফেলা যায়, টস জিতে দুই টেস্টে পর পর আগে ফিল্ডিং করার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মুশফিকের একার নয়, টিম সিদ্ধান্ত। কোচ আর অধিনায়ক মিলেই এ সিদ্ধান্ত নেন।

কোচ হাথুরুসিংহে এখন পুরো দলে জেঁকে বসেছেন। ব্যাটসম্যান-বোলারদের তৈরি করা আসল লক্ষ্য পরিকল্পনা আঁকার মাঝেই তার কাজ শেষ নয়। হাথুরু দল সাজানো, একাদশ তৈরি, ব্যাটিং অর্ডার নির্ধারণ সবই করেন। সেখানে একজন অধিনায়কের স্বাধীনতা ও ইচ্ছে মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কতটা?

তা নিয়েও আছে প্রশ্ন। তাই কারও কারও মুখে এমন কথা ‘মুশফিক কি বলির পাঠা হলেন?’ তাকে নিয়ে যত কথা, রাজ্যের সমালোচনা, তার সব দায়-দায়িত্ব কি একা মুশফিকের? কোচ হাথুরুসিংহে কি ‘ধোয়া তুলসি পাতা?’

উপমহাদেশের দলগুলোর দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়ে মুখ পড়ার রেকর্ড আছে ভুরিভুরি। সেখানে বাংলাদেশ খেলতে গেছে নয় বছর পর। যে দলের বেশির ভাগ সদস্য এই প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে খেলতে গেছেন। সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি মানিয়ে স্বাভাবিক পারফরম করা মোটেই সহজ নয়।

ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপে এ কথা বার বার বলে গেছেন। তার সোজাসাপ্টা কথা, উপমহাদেশের দলগুলোর দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ভালো খেলার রেকর্ড কম। ওই কন্ডিশনে ভালো করা সত্যিই কঠিন। দেশ ছাড়ার আগে সবাইকে এ কঠিন সত্য মেনে নিতে অনুরোধও করেছেন মাশরাফি।

সেখানে টেস্টে ভরাডুবির জন্য একা মুশফিককে দায়ী করা কতটা যুক্তিযুক্ত? বাংলাদেশ শেষ দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৯০ ও ১৪৭ রানে অলআউট হয়েছে। আগে ব্যাট করে যদি ওই রানে অলআউট হতো, তাহলে আরও করুণ পরিণতি ঘটত। তখন কি মুশফিকের ওপর সব দায় দায়িত্ব ও দোষ চাপানো যেত?

এআরবি/এমআর/আইআই