কৃষি ও প্রকৃতি

ভাসমান সবজি চাষ জনপ্রিয় করতে বড় উদ্যোগ

ভাসমান সবজি ও মসলা চাষ জনপ্রিয় করতে বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য গবেষণার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি ও মসলা চাষে সফলতা দেখিয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি উচ্চফলনশীল আধুনিক জাত উদ্ভাবন করেছে সংস্থাটি।

Advertisement

উদ্ভাবিত জাত এখন মাঠপর্যায়ে প্রবর্তন করতে চায় কৃষি মন্ত্রণালয়। সেজন্য আলাদা প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনে এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা পাঠান হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপ্রবণ দেশে হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে কৃষি খাত। এ অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষে গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ’ শীর্ষক এক প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়, যা বাস্তবায়ন করবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য এ এন সামসুদ্দিন আজাদ চৌধুরী বলেন, প্রকল্পটি দেশের কৃষি সম্প্রসারণ ও খ্দ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি। গুরুত্ব বিবেচনায় আগামী জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) পরবর্তী সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, শাকসবজি ও মসলার উৎপাদন বাড়ানোর জন্য স্থানভিত্তিক ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষে গবেষণার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে সম্প্রসারণেরও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষের সম্পূর্ণ অর্থায়ন যৌথভাবে রাংলাদেশ রাইস গবেষণা ইনস্টিটিউশন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে দেয়া হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ২০২২ সাল পর্যন্ত। ১৩টি জেলার ২৫টি উপজেলায় দুই পর্যায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

প্রথম পর্যায়ে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল বিভাগের বরিশাল সদর ও পিরোজপুর, খলনা বিভাগের খুলনা ও বাগেরহাট, চট্টগ্রামের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী এবং সিলেট বিভাগের সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

Advertisement

দ্বিতীয় পর্যায়ে গোপালগঞ্জ, মাদরীপুর, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, যশোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, সিলেট, হবিগঞ্জ, নাটোর, রংপুর, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে আমাদের কৃষি খাত। এরই মধ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ওইসব অঞ্চলের মাটি ও পানিতে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এছাড়া জলমগ্নতা, উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যা এবং একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে।

জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে দীর্ঘ সময়ের জন্য অনেক স্থান জলমগ্ন হয়ে পড়ছে। হাওর এলাকায় আকস্মিক বন্যায় প্রায় সময় বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে স্থানভিত্তিক সৃজনশীল কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং এর সম্প্রসারণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

ইতোমধ্যে ভাসমান পদ্ধতি ব্যবহার করে অনেক কৃষক ফসল উৎপাদন শুরু করেছেন। এ পদ্ধতিতে তারা সফলতাও দেখিয়েছেন। ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি ও মসলা চাষের জন্য স্থানীয় ও কম ফলনশীল জাতের বীজের ব্যবহার হচ্ছে। একই সঙ্গে এ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনও করা হচ্ছে।

গেল বছর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জলজ উদ্ভিদ কচুরিপানার ধাপে ভাসমান সবজি ও মসলা চাষের মাধ্যমে কৃষকরা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেন। ওই পদ্ধতিতে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করে লাভের মুখ দেখেন স্থানীয় কৃষকরা।

বর্ষা মৌসুমে টুঙ্গিপাড়া উপজেলার অধিকাংশ জমি পানির নিচে চলে যায়। সেসময় কৃষকের কোনও কাজ থাকে না। টুঙ্গিপাড়ায় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট্রের আওতায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ভাসমান সবজি ও মসলা উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার।টুঙ্গিপাড়া উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ওই প্রকল্পের আওতায় ২০টি গ্রামে ভাসমান ধাপে মসলা ও সবজির চাষ করা হয়। উপজেলায় অন্তত এক হাজার কৃষক পরিবার ৫০ থেকে ৭০ ফুট দৈর্ঘ্যের প্রায় পাঁচ হাজার ধাপ তৈরি করে ঢেঁড়স, গিমাকলমী, পুঁইশাক, বরবটি, শশা, করলা, বাঙ্গি, হলুদ, লালশাক ও ডাঁটাশাক আবাদ করেন। উপজেলায় প্রায় ৭৫ বিঘা ভাসমান বেড তৈরি করে এসব সবজি চাষ করা হয়। উৎপাদিত হয় প্রায় ২০০ টন।

ভাসমান বেডে সবজি চাষ প্রসঙ্গে টুঙ্গিপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. এইচ এম মনিরুজ্জামান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নিম্নাঞ্চলের কৃষকদের কচুরিপানা দিয়ে ভাসমান সবজি চাষ একটি চমৎকার সমাধান। এ পদ্ধতিতে সবজি ও মসলার উৎপাদন প্রায় পাঁচ থেকে ছয়গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।

জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ভাসমান পদ্ধতিতে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সবজি ও মসলার উচ্চফলনশীল আধুনিক জাত উদ্ভাবন করেছে। এগুলোর ফলন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনে পাঠান প্রকল্প প্রস্তাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, স্থানভিত্তিক ভাসমান পদ্ধতিতে কৃষির আধুনিক ও লাগসই প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা হবে। একই সঙ্গে ফসলের উপযোগিতা পরীক্ষা করা হবে। ভাসমান বেড তৈরিতে কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের সহজলভ্যতা বিবেচনা করে সীমিত কচুরিপানা বা জলজ উদ্ভিদভিত্তিক ভাসমান কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হবে।

সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির অনুমোদন পেলে চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন নাগাদ তা বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভাসমান কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা, বিভিন্ন কর্মশালা- মাঠ দিবস ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির সফল আয়োজন এবং ভাসমান কৃষি বিষয়ে স্টেকহোল্ডারদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে।

কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের দাবি, দেশের ২৪টি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ভাসমান কৃষিভিত্তিক আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, ভাসমান বেডে সবজি ও মসলার প্রদর্শনী স্থাপন, কৃষক ও মাঠপর্যায়ে কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে এ পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বাড়ান সম্ভব হবে। একই সঙ্গে দেশের সবজি ও মসলার উৎপাদন বাড়বে, খাদ্য নিরাপত্তা আরও নিশ্চিত হবে।

প্রসঙ্গত, ভাসমান বেডে মসলা ও সবজি চাষ করে সফল হয়েছেন দেশের অনেক কৃষক। উৎপাদিত সবজি বাজারে বিক্রি করে ইতোমধ্যে অর্থ উপার্জনও করেছেন তারা। বর্তমানে ভাসমান বেড স্থাপন করা হচ্ছে কচুরিপানা দিয়ে ধাপ বানিয়ে। সেই ধাপের ওপর লালশাক, পুঁইশাক, ডাটাশাক, গিমাকলমি, ঢেঁড়শ, সীম, লতিরাজ কচু, লাউ, হলুদ প্রভৃতি সবজি চাষ করা হচ্ছে।

এমএ/এমএআর/এমএস