বিশেষ প্রতিবেদন

বিন্দু পরিমাণ নোংরামি ছিল না প্রতিযোগিতায়

জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল। ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ' হয়ে ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ আসরে লড়াইয়ের কথা ছিল তার। কিন্তু বিয়ের তথ্য গোপনের অভিযোগে মুকুট হারাতে হয় এই সুন্দরীর।

Advertisement

‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার আয়োজক সংস্থা ‘অন্তর শোবিজ’কে নিয়েও নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। সমালোচনা হলেও এমন একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করায় আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এভ্রিল। প্রতিযোগিতার খুঁটিনাটি নানা বিষয়সহ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সম্প্রতি জাগো নিউজ’র মুখোমুখি হন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। জাগো নিউজ : অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে সুন্দরী প্রতিযোগিতা ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ- ২০১৭’র আয়োজন। বিতর্কের কেন্দ্রে আপনি-ই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন একটি আয়োজন নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি?

এভ্রিল : সম্ভবত ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে সুন্দরী প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৭ সালে আবারও যাত্রা শুরু। আমি মনে করি এটা একটি শুভযাত্রা। যারা এমন একটি আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

এমন প্রতিযোগিতায় বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মেয়েরাও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে- এমন সুযোগ তৈরি করেছে ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’র এ আয়োজন। পাশের দেশ ভারত বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে মুকুট জিতেছে। বাংলাদেশের নারীরা কেন পিঁছিয়ে থাকবে?

Advertisement

ছবি- মাহবুব আলম জাগো নিউজ : এমন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারাই কি নারীর এগিয়ে যাওয়া?

এভ্রিল : বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে রিপ্রেজেন্ট (উপস্থাপিত) করার তো একটি ক্ষেত্র তৈরি হলো বটে। বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে একটি মেয়ে যাবে, তখন সে বাংলাদেশেরই প্রতিনিধিত্ব করবে। প্রতিযোগিতায় কেবল একজন সুন্দরী নারী নয়, তাকে আরও অনেক গুণের অধিকারী হতে হয়। ওই নারী তার সৌন্দর্য ও গুণের মাধ্যমে বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পান।

জাগো নিউজ : নিজেকে নিয়ে তা-ই মনে করেন কি?

এভ্রিল : হ্যাঁ। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেতনা আমার শৈশব থেকেই ছিল। বাল্যবিয়ের ভিকটিম (শিকার) আমি নিজেই। স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে জীবনের সঙ্গে লড়াই করে আজ আমি এই জায়গায় এসেছি। অন্য মেয়েদের কাছে আমি উদাহরণ হয়ে থাকতে চাই।

Advertisement

জাগো নিউজ : এমন মঞ্চে এলেই কি মানুষের পাশে দাঁড়ান যায়?

এভ্রিল : এটা নারীর জন্য একটি মঞ্চ মাত্র। এখানে এসে নারী তাকে উপস্থাপন করতে পারেন। অন্য অসহায় নারীর কথা বলতে পারেন।

জাগো নিউজ : কিন্তু এমন মঞ্চে তো নারীকে শুধু পণ্য বা বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। আপনি এত আশাবাদী কেন?

এভ্রিল : আমার কাছে তা মনে হয়নি। একটি মেয়ে গোটা দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব নেবেন; তাকে পণ্যের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক নয়।

ছবি- মাহবুব আলম

জাগো নিউজ : সুন্দরী হওয়ার সঙ্গে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সম্পর্ক কী?

এভ্রিল : এবার চীনের সাংহাইয়ে যে সুন্দরী প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে বিজয়ীরা এতিম-অসহায় শিশুদের জন্য কাজ করবেন। এতিমদের জন্য প্রতিযোগিতা থেকে ফান্ড গঠন করা হবে। অসহায়দের জন্য তো একটি সম্পর্ক দাঁড়ায়ই বটে।

জাগো নিউজ : মানুষের পাশে দাঁড়ান হচ্ছে মানুষের দায়। এমন রঙিন মঞ্চে নিজেকে বস্তু হিসেবে মেলে ধরে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ আসলে কতটুকু?

এভ্রিল : এখানে মেয়েরা নিজের যোগ্যতা দিয়ে প্রমাণ করেন। বস্তু হিসেবে এখানে কোনো নারী নিজেকে মেলে ধরে বলে আমার কাছে মনে হয়নি। যোগ্যতা আছে বলেই একজন মেয়ে হাজার হাজার প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে নিজেকে প্রমাণ করেন। চাইলে নারী তার মনের সৌন্দর্য দিয়ে মানুষের পাশেও দাঁড়াতে পারেন।

জাগো নিউজ : পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে এমন সুন্দরী প্রতিযোগিতা- সমালোচকরা অন্তত তাই মনে করেন। পুরুষরা যা চায়, তাই হয় এসবে?

এভ্রিল : আমার কাছে তা মনে হয় না। এখানে নারীরও স্বাধীনতা থাকে। বিশ্ব প্রতিযোগিতার আয়োজক কমিটির প্রধান এখন একজন নারী।

জাগো নিউজ : ওই নারীও পুরুষের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন? মননে পুরুষতান্ত্রিকতা কাজ করে নারীরও।

এভ্রিল : কিন্তু এখানে যারা অংশ নেন তাদেরও একটি মন থাকতে পারে এবং তা স্বতন্ত্র। স্বাধীনতার বিষয়টি আপেক্ষিক। ব্যক্তিবিশেষেও নির্ভর করে। পুরুষের চাহিদা মতোই এখানে সব হয়, তা মনে করি না।

একজন মেয়ের ফিগারের মাপ নেয়া হয় মানে তার ভেতরের রূপের সৌন্দর্যও এতে উঠে আসে।

ছবি- মাহবুব আলম

জাগো নিউজ : বাইরের সৌন্দর্যের সঙ্গে ভেতরের রূপের সম্পর্ক থাকবে কেন? দেখতে অসুন্দর হলেই কি তার মন অসুন্দর হতে পারে?

এভ্রিল : বাইরের রূপের সঙ্গে মিলিয়েও কিন্তু আপনি একজন মানুষের মনের খবর নিতে পারেন। ভেতর ও বাইরে মিলিয়েই একজন ভালো মানুষ হয়।

জাগো নিউজ : অনেক সুন্দর চেহারার মানুষও অসুন্দর কাজ করেন।

এভ্রিল : আমাদের যখন গ্রুমিং করা হয়, তখন প্রতিটি মুহূর্তই মনিটরিং করা হয়। সৌন্দর্যের অন্তরূপ নিয়েও নানা ব্যাখ্যা মেলে এবং প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। সুন্দর মানুষরা অসুন্দর কাজ করতে পারেন না।

জাগো নিউজ : অনেকেই তো মনে করেন এমন গ্রুমিং করতে গিয়ে নারীর ভেতরের রূপ আরও ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

এভ্রিল : নিজের প্রতি বিশ্বাস ও সম্মানবোধ থাকলে কারও ভেতরের রূপ ফ্যাকাশে হতে পারে না।

জাগো নিউজ : তার মানে আপনি সচেতনভাবেই এমন প্রতিযোগিতার পক্ষে?

এভ্রিল : হ্যাঁ। আমি সচেতনভাবেই এমন আয়োজনকে সাধুবাদ জানাই।

জাগো নিউজ : অনেক সচেতন নারীই তো সুন্দরী প্রতিযোগিতার সমালোচনা করেন?

এভ্রিল : সবাই সব বিষয় সমানভাবে গ্রহণ করবে- এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। আমি ইতিবাচকভাবেই দেখতে অভ্যস্ত।

জাগো নিউজ : অভিযোগ আছে এমন আয়োজনে নারীর শরীর-ই অধিক গুরুত্ব পায় আয়োজকদের কাছে। বৈশ্বিক আয়োজনের বহু প্রমাণও মিলেছে। আপনার অভিজ্ঞতা কী?

এভ্রিল : নারী নির্যাতনের ঘটনা সমাজের অন্যত্রও ঘটে। আবার সমাজেই নারীর সম্মান মেলে। তবে আমি গর্ববোধ করি, বাংলাদেশে এমন একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পেরে। আমাদের নিয়ে বিন্দু পরিমাণ নোংরামী ছিল না।

আয়োজক প্রতিষ্ঠান ‘অন্তর শোবিজ’র চেয়ারম্যান স্বপন চৌধুরী আমার বাবার মতো। তাকে আমি স্যার বলি। তার স্ত্রী নাসরীন ম্যাম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন।

ছবি- মাহবুব আলম

জাগো নিউজ : অন্যদের জন্য কী বলবেন?

এভ্রিল : নারীরা এখনও অনিরাপদ। তবে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রাখলেই নারী অনেক ক্ষেত্রে নিরাপদ থাকতে পারেন। এমন আয়োজনে আত্মবিশ্বাস বাড়ে বলেই বিশ্বাস করি।

জাগো নিউজ : তথ্য গোপনের দায়ে আপনার চ্যাম্পিয়নের মুকুট কেড়ে নেয়া হলো। আপনি কি এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত?

এভ্রিল : মোটেও না। যেদিন থেকেই আমার বিয়ের খবর প্রকাশ পেয়েছে, সেদিন থেকেই আমি এসব বিষয় মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি। দুর্বল করতে আমার আত্মহত্যার গুজবও রটানো হয়। আত্মহত্যা করব- এমন মেয়ে আমি নই।

আমার বার্তা এখন পরিষ্কার। বাল্যবিয়ে বন্ধের যে দায়িত্ব আমি নিয়েছি, তাতেই আমি সন্তুষ্ট থাকতে চাই।

জাগো নিউজ : মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাইছেন। আবার বিয়ের তথ্য গোপন করেছেন। তার মানে যেকোনো পন্থা অবলম্বন করেই নিজেকে প্রকাশ করতে চাইছেন, সেটা প্রতারণা হলেও!

এভ্রিল : আমি বুঝতে পারছি না বারবার কেন আমাকে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে!

জাগো নিউজ : কিন্তু তথ্য তো গোপন রাখলেন। এমনকি বিয়ের সময়কার বয়সও?

এভ্রিল : যে বিয়েতে আমার মত ছিল না, সেটাকে আমি আসলে বিয়েই মনে করি না। এ কারণে তথ্য গোপনের বিষয়ও গুরুত্ব পায় না। আমি তার সঙ্গে সংসার করিনি। এ দায়ভার আমি কেন নেব?

জাগো নিউজ : বিয়ের নামে যেটুকু হয়েছে, তা তো আয়োজকদের কাছে স্বীকার করেননি?

এভ্রিল : বিয়ের বিষয়টি আমি চার বছর আগেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি। নিজেকে পরিবর্তনের মাধ্যমে গুছিয়ে একটি নতুন জীবন দেয়ার চেষ্টা করেছি। আমি আমার স্বপ্নটাকে নিজের মতো করে লালন করেছি।

জাগো নিউজ : এই স্বপ্ন নিয়ে এখন কোথায় যেতে চান?

এভ্রিল : আমি ‘এভ্রিল চ্যারিটেবল’ নামে একটি ফাউন্ডেশন করব। আমি অনেক ভালো জায়গায় কাজ করার প্রস্তাব পাচ্ছি। মিডিয়ায় কাজ করতে চাই। তবে যেখানেই কাজ করি না কেন, উপার্জিত আয়ের শতকরা ৭০ ভাগ অর্থ আমার চ্যারিটেবল ফান্ডে দেব। বাল্যবিয়ে রোধে আজীবন কাজ করে যাব।

এএসএস/এমএআর/আরআইপি