আন্তর্জাতিক

পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে আরও ৬ প্রাণী

বিলুপ্ত হওয়া প্রাণীর তালিকায় সর্বপ্রথম আসে ডাইনোসরের নাম। সম্ভবত হারিয়ে যাওয়া প্রাণীর তালিকায় ডাইনোসরের মতো বিকল্প আর কোনো নাম সহজে মনে আসে না। কেবল ডাইনোসর নয় গত ৫০০ মিলিয়ন বছরে ডাইনোসরের মতো পৃথিবী থেকে অন্তত চার প্রজাতির প্রাণীর সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটেছে।

Advertisement

এখানেই কেবল শেষ নয়। সম্পূর্ণ বিলুপ্তির পথে রয়েছে আরো ছয় প্রজাতির প্রাণী।

অতীতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণ ছিল তাদের গণমৃত্যু। কিন্তু এই সময়ে প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার কারণ হচ্ছে ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত কারণ। বিজ্ঞানীদের ভাষ্য : আমরা আরও অনেক প্রাণী এই সময়ে হারিয়ে ফেলব। হারিয়ে যাওয়ার কারণগুলো আমাদেরই তৈরি।

ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমি পত্রিকায় সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্তির শঙ্কাকে ‘জৈবিক বিসর্জন’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে।

Advertisement

মেক্সিকোর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটির স্থল অঞ্চলের ২৭ হাজার মেরুদণ্ডী প্রাণীর ওপর গবেষণা চালায়। মেরুদণ্ডী এ সব প্রাণীর সংখ্যা অর্ধেকে কমে এসেছে। এবং টিকে থাকা অর্ধেক মেরুদণ্ডী প্রাণীর বংশবিস্তার ৩২ শতাংশ হারে কমেছে।

একইসঙ্গে তারা ১৭৭ স্তন্যপায়ী প্রাণী নিয়ে গবেষণা চালায়। সেখানে দেখা দেয় নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় তাদের এত তৃতীয়াংশ হারিয়ে গেছে। এবং দুটো প্রজাতির একটির বংশবিস্তার মারাত্মক হারে কমেছে।

কিছু কিছু স্তন্যপায়ীপ্রাণী যারা একদশক-দুইদশক আগে নিরাপদে ছিলেন এখন তারা বিপদাপন্ন। সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ১৯৯৩ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত আফি্রকান সিংহের সংখ্যা ৪৩ শতাংশ কমেছে।

বিজ্ঞানীদের ওই গবেষণার উদ্দেশ্য কেবল দুই একটি প্রজাতির বিলুপ্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া নয়। লিভিং প্লানেট ইনডেক্স এর তথ্য অনুযায়ী ৩৭০৬ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণীর সূচক নিম্নমুখি প্রবণতায় সেই বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন।

Advertisement

বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, বিলুপ্ত বা বিলুপ্তির পথের প্রাণীদের মৃত্যুর হার দ্রুততগতিতে বেড়েছে। গত ১০০ বছরে ২০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণীর বিলুপ্তি হয়েছে। যা প্রতিবছরে গড়ে দুইজন। কিন্তু গত ১০ হাজার বছরে এই দুইশ প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে। পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিলুপ্তির হার দ্রুতগতির হচ্ছে।

প্রাণীদের এই বিলুপ্ত হওয়ার সমস্যা অপরিবর্তনীয় এবং এটি আমাদের অভিযোজন প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলবে। যার প্রভাব পড়বে মানুষের ওপর, গোটা পৃথিবীর ওপর।

বাংলাদেশে বিলুপ্ত বন্যপ্রাণী এরইমধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাণী। এশিয়া মহাদেশে যে তিন রকমের গন্ডার এখনো দেখা যায়, সেই ভারতীয়, সুমাত্রান আর জাভাদেশীয় গন্ডারের তিনটি প্রজাতি একসময় বহুল পরিচিত ছিল আমাদের দেশে। সিলেট অঞ্চলে দেখা যেত ভারতীয় প্রজাতিটি। সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিনে পাওয়া যেত অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের সুমাত্রান ও জাভাদেশীয় গন্ডার। কিন্তু সেটি এখন নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আর ঢাকা বিভাগের উত্তরে বাস করত গৌর বা বন্য গরু। গৃহপালিত গরুর এই পূর্বপুরুষরা আকার-আকৃতিতে বিশাল, প্রায় ছয় ফুট উঁচু এবং তদানুপাতে লম্বা। মাংসের লোভে মানুষের নির্বিচারে শিকারের কারণেই বিলুপ্ত হয়ে যায় বন্য গরু। খুব সম্ভবত বাংলাদেশের শেষ গৌরটিকে শিকার করা হয় ১৯৭১ সালে, টেকনাফের জঙ্গলে।

গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪০-এর দশকেও সুন্দরবন অঞ্চলে বন্য মহিষ দেখা যেত। কাদা পানিতে থাকতে এরা পছন্দ করত। শিকার আর গৃহপালিত পশু থেকে ছড়ানো মারাত্মক সব রোগের প্রাদুর্ভাবে এরা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

একসময় উত্তরবঙ্গ আর ভাওয়াল মধুপুরের গড়ে ময়ূর দেখা যেত। কিন্তু নির্বিচারে শিকারের ফলে অনেকটা অজান্তেই হারিয়ে গেছে এরা বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে। বহুদিন পর্যন্ত গবেষকদের ধারণা ছিল, ঢাকার ভাওয়ালের জঙ্গলে এখনো কিছু ময়ূর টিকে থাকতে পারে। কিন্তু পরে খোঁজখবর করে দেখা যায়, ১৯৮০-এর দিকেই এরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ময়ূরের আরেক জ্ঞাতি সবুজ ময়ূর বা বর্মী ময়ূর ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরসবুজ অরণ্যে টিকে ছিল, কিন্তু এরাও পরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের নদীনালা থেকে শুরু করে বদ্ধ জলাঞ্চলেও প্রচুর পরিমাণে দেখা যেত জলার কুমির। ১৩ থেকে ১৬ ফুট লম্বা এই কুমিরগুলো কিন্তু সচরাচর মানুষকে আক্রমণ করত না, কিন্তু মানুষ তা বুঝলে তো! কিছুটা ভয়ে, সেই সঙ্গে পরে কুমিরের চামড়ার রমরমা ব্যবসার কারণে মানুষ এদের মেরে শেষ করে দিয়েছে। বাংলাদেশে জলার এই কুমিরের শেষ বংশধর ছিল বাগেরহাটের খানজাহান আলীর পুকুরের প্রসিদ্ধ কুমিরগুলো। দেশের অন্যত্র পঞ্চাশের দশকের পর থেকেই এদের আর দেখা যায় না।

দুইশ বছরে হারিয়েছে তিনশ প্রজাতি কৃতির ওপর মানুষের অপশাসন, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে দেশে গত দুইশ বছরে তিনশ প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরমধ্যে দেড়শ প্রজাতিই বন্যপ্রাণী। এছাড়া বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার তালিকায় রয়েছে ১৩ প্রজাতির মেরুদ- প্রাণী, ৪৭ প্রজাতির দেশী পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর, ৬৩ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।

বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে ৪৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ১০৬ প্রজাতির নলবাহী উদ্ভিদ। দেশে ১১ বছরে ৩৩৪ টি বাঘ কমেছে। খাদ্যের অভাবে কমেছে হাতির সংখ্যাও। এই তথ্য ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশ ও দ্য ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন,বাংলাদেশ-এর। গত বছর তারা এই পরিসংখ্যান দেয়।

বিলুপ্তির পথে ৪১ প্রজাতির পাখি দেশের আরো ৪১ প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির পথে। এর মধ্যে রয়েছে কালো তিতির, জলা তিতির, কালো ময়ূর, লাল ট্রোগন, পাহাড়ি নীলকণ্ঠ, মাছরাঙা ও পাকড়া ধনেশ, হুতোমপেঁচা ইত্যাদি।

বিলুপ্তির পথে ৫৪ প্রজাতির মাছ একসময় দেশের নদ-নদী ও জলাশয়গুলোতে ২৬৬ প্রজাতির মিঠা ও ঈষৎ লোনা পানির মাছ পাওয়া যেত। এর মধ্যে ৬৬ প্রজাতির এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। অবশিষ্ট ২০০ প্রজাতির মধ্যে ৫৪টিও বিপন্নপ্রায়। ৪৪২ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের মধ্যে চারটির অবস্থা নাজুক।

পৃথিবীর বুকে থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রাণীরা বিবর্তন ও ক্রমগত পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাবের ফলে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে অনেক প্রাণী। এক সময় যাদের দেখা যেত সর্বদায় বিচরণ করতে আজ তারা হারিয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে। পৃথিবীতে বেশ কিছু বিশাল আকারের প্রাণী ছিল। ডাইনোসরের মতোই কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে তারা। তাদের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে মানুষেরও হাত।তাসমানিয়ান বাঘ বা Thylacine ছিল একটি পরিচিত মাংসাশী প্রাণীর নাম। বিংশ শতাব্দীতে অস্ট্রেলিয়া এবং নতুন গিনিতে ওগুলো কিছুটা দেখতে পাওয়া যেত। তবে এটাকে Tasmanian Wolf নামেও ডাকা হত। Thylacine মহাদেশের ইউরোপীয় উপনিবেশের পূর্বে অস্ট্রেলিয়া এবং পরে বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জে এগুলো দেখতে পাওয়া যেত। ধারণা করা হয় এটি ১৯৩৬ সাল থেকে বিলুপ্ত হয়েছে।কাসপিয়ান টাইগার ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, তুরস্ক, মঙ্গোলিয়া, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তানে, উজবেকিস্তানে এটি পাওয়া গিয়েছিল। যা ১৯৭০ সালের দিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এই প্রজাতির বাঘটি ছিল বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম বাঘ।

আফ্রিকা মহাদেশের বিচিত্র বিলুপ্ত একটি প্রাণী হচ্ছে Quagga। এই প্রাণীটি দেখে অনেকটাই অকল্পনীয় প্রাণী মনে হয়। কিন্তু এটিও কোনো একসময় সচরাচর দেখতে পাওয়া যেত। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রদেশে একবার খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল এবং যা ছিল একটি বিরল ঘটনা। এই প্রাণীটির প্রথম অর্ধেক অংশ ছিল জেব্রার মতো দেখতে কিন্তু পেছনের অংশ ছিল ঘোড়ার মতো।

ধারণা করা হয় এটি ১৮৮৩ সালের পর থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। এটাকে ১৭৮৮ সালে প্রাণীদের একটি প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সর্বশেষ ১৮৭০ সালের দিকে একটি Quagga পাওয়া যায়, যেটিকে Artis Magistra zoo তে সংরণে রাখা হয়। কিন্তু সর্বশেষ পাওয়া এই প্রাণীটি ১৮৮৩ সালের ১২ আগস্ট মারা যায়।

অ্যাওরোকস : Aurochs এই প্রাণীটি কোনো একসময় ইউরোপের বিখ্যাত একটি প্রাণী ছিল। যা ভারত ও এশিয়ার আরো কিছু দেশে পাওয়া যেত। ১৫৬৪ সালে gamekeepers রাজকীয় পরিসংখ্যান অনুসারে কেবল ৩৮ প্রাণীর সংখ্যা বের করতে পেরেছিল। তবে ১৬২৭ সালে এই প্রাণীকে পূর্ণাঙ্গভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছ। এ সব প্রাণী আর দেখা যায়নি তাদেরই এই পৃথিবীতে।

গ্রেট আক প্রাণীটি ছিল পেঙ্গুইনদেরই একটি প্রজাতি, যা Atlantic সমুদ্রের পাড়ের দ্বীপ ও দেশগুলোতে পাওয়া যেত। কিন্তু এগুলো আজকে বিলুপ্ত। এগুলো দাঁড়ানো অবস্থায় ৭৫ সেন্টিমিটার অথবা ৩০-৪০ ইঞ্চি হয়ে থাকত। এগুলোর ওজন ৫ কেজির মতো হয়ে থাকত। এগুলো আগে কানাডা, গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও ব্রিটেনে বহু সংখ্যক খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল এবং শিকারও করা হয়েছিল। তবে ১৮৪৪ সালের পর থেকে এগুলো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এ সব প্রাণী আর দেখা যায়নি তাদেরই এই পৃথিবীতে।

বিলুপ্তির দায় কার ?কেউ বলছেন মানুষের শিকারের কারণে এরা বিলুপ্ত হয়েছে আবার কেউ বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এমনটি হয়েছে। এ তর্ক অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। তারা একই ধরনের প্রমাণ দেখছেন কিন্তু ভিন্ন ভিন্নভাবে সেটিকে ব্যাখ্যা করছেন। শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল তার এক লেখায় গত বছর বলেন, আসলে দুটি বিষয়ের কোনোটিই অযৌক্তিক নয়। দুটি তথ্যেরই যৌক্তিকতা আছে। এটা কী হতে পারে না, যে প্রাণীগুলো মানুষের অধিক শিকার ও জলবায়ু পরিবর্তন উভয় কারণেই হয়েছে? গবেষক সুরভেল বলেছেন, ‘কোনো ঘটনার পেছনে একের অধিক কারণ থাকাটা সম্ভব।’ সুরভেল এটাও বলেন, ‘আমরা সবাই একই প্রমাণ দেখছি কিন্তু এটাকে আমরা ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছি।’ তুষার যুগের প্রাণী বিলুপ্তির পেছনের মূল কারণ এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি। কিন্তু বর্তমানে যে বিপুল সংখ্যক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তার জন্যে নিঃসন্দেহে আমরা অর্থাৎ মানুষই দায়ী।

বর্তমানে জলবায়ু খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে যার মুল কারণ মানুষের কর্মকাণ্ড। যার ফলে প্রচুর পরিমাণ প্রাণী ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

সূত্র : উইফোরাম, পরিবেশ অধিদপ্তর, ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমি, ইন্টারনেট

একে/আরআইপি