মতামত

কাতালোনিয়ায় স্বাধীনতা আন্দোলনের কারণ ও বাস্তবতা

সম্প্রতি বিশ্ব-রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা স্বাধীনতার দাবিতে স্পেনের কাতালোনিয়া অঞ্চলে অনুষ্ঠিত গণভোট। স্পেনের আদালত সেখানকার ভোটগ্রহণকে সাংবিধানিকভাবে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করেছে।

Advertisement

গত ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এই ভোটকে কেন্দ্র করে পুরো ইউরোপের রাজনীতিতে ছিল এক ধরনের টান টান উত্তেজনা। স্পেন সরকার কর্তৃক এ ভোটগ্রহণকে অবৈধ ঘোষণা করার পর কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামীদের তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং স্পেন প্রশাসনের এই ভোটগ্রহণ বন্ধ করার চেষ্টা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি।

নানা উ‍ৎকণ্ঠা ও নাটকীয়তার পর শেষ পর্যন্ত নির্বাচন সম্পন্ন হলেও নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় প্রাণহানি না ঘটলেও ৮৯৩ জন আহত হয়েছে এবং গ্রেফতার হয়েছে কাতালোনিয়া প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা।

নির্বাচন শেষে কাতালোনিয়ার প্রেসিডেন্ট কার্লোস পুইজডেমন্ড তার বক্তব্যে দাবি করেন, গণভোটে ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। যার ৯০ শতাংশই পড়েছে স্বাধীনতার পক্ষে।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, এ ভোটের মাধ্যমে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার দরজা খুলে গেছে। কাতালোনিয়ার নাগরিকরা প্রজাতন্ত্রের আদলে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ গড়ার অধিকার অর্জন করেছে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কেন্দ্রীয় সরকার বরাবরই কাতালানদের স্বাধীনতার এই দাবি নাকচ করে দিয়েছে। গত রোববার কাতালোনিয়ায় অনুষ্ঠিত গণভোটটি ছিল দ্বিতীয় গণভোট। এর আগে ২০১৪ সালের নভেম্বরে একটি অনানুষ্ঠানিক গণভোটের আয়োজন করেছিল কাতালানরা।

সেই ভোটেও স্বাধীনতার পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হয়েছিল। তাদের দাবি অনুসারে, ৮০ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। সরকার সেই ভোটগ্রহণও বন্ধ করতে চেয়েছিল; কিন্তু পারেনি।

এবার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নে নির্বাচনের দিকে এগিয়েছে কাতালান প্রশাসন। কাতালোনিয়ার পার্লামেন্টে গণভোট প্রসঙ্গে একটি আইন তৈরি করা হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে। সেই আইনে একটি প্রশ্ন রাখা হয়, ‘আপনারা কি চান কাতালোনিয়া প্রজাতন্ত্রের আদলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ওঠুক?’

Advertisement

সেখানে দুটি ভোট দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়; ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’। বিতর্কিত এই আইনটিতে বলা হয়, গণভোটের ফলাফল নির্বাচন কমিশন পার্লামেন্টে পাঠানোর দুদিনের মধ্যে পার্লামেন্ট কাতালোনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।

এই আইন ঘোষণার পর কাতালোনিয়ার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন, অন্য কোনো আদালত বা রাজনৈতিক শক্তি তার সরকারকে ক্ষমতা থেকে বরখাস্ত করতে পারবে না। এই আইন পাস হওয়ার পর স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাখই এই ভোটের প্রক্রিয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, আমি অত্যন্ত নরম সুরে কিন্তু কঠোর করে বলতে চাই, কোনো গণভোট হবে না।

প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে স্পেনের সাংবিধানিক আদালত কাতালোনিয়ার ওই বিতর্কিত আইনটি বাতিল করে ভোটগ্রহণকে অবৈধ ঘোষণা দাবি করে। কারণ, স্পেনের সংবিধানে দেশটির মানচিত্রের অখণ্ডতা রক্ষার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।

ভোটগ্রহণের আইনটি বাতিল করার পর কাতালানরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কাতালোনিয়ায় শুরু হয় গণআন্দোলন। বিপরীতে বার্সেলোনাসহ স্পেনজুড়ে দেশটির অখণ্ডতা রক্ষার ভোটগ্রহণ বন্ধের দাবিতেও সমাবেশ হয়।

কিন্তু কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার তীব্র দাবির মুখে সেই আন্দোলন ম্লান ছিল। এরই মধ্যে স্পেনের উচ্চ আদালত নির্বাচনের দিন সকাল ৬টা থেকে স্থানীয় স্কুল-কলেজ ভবনের যেসব কেন্দ্রগুলোতে ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, সেগুলো বন্ধ করে দেয়ার জন্য প্রশাসনকে নির্বাহী আদেশ দেয়।

নির্বাচন বানচাল করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের এসব কৌশল ও কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে বিছিন্নতাবাদীদের ভোট দেয়ার আন্দোলন মুখোমুখি করে দেয় দুই পক্ষকে।

ফলে ১ সেপ্টেম্বরের নির্বাচন ঘিরে ইউরোপিয়ান একটি রাষ্ট্রে এমন নজিরবিহীন সহিংসতা দেখা যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন কাতালোনিয়া স্বাধীনতা চাচ্ছে?

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হলে, আগে অঙ্গরাজ্য হিসেবে কাতালোনিয়া স্পেনের জন্য কতটুকু গুরুত্ব বহন করে সেটা বুঝতে হবে। স্পেনের উত্তর-পূর্ব কোণের প্রান্তিক অঞ্চলে ৩২ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ কাতালোনিয়া রাজ্যে প্রায় ৭৫ লাখ মানুষ বাস করে।

যা স্পেনের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ। রাজ্যটি আয়তনে ছোট হলেও স্পেনের অর্থনীতিকে সচল রাখতে অন্য যে কোনো রাজ্য থেকে অনেক বেশি ভূমিকা রাখে। কাতালোনিয়া স্পেনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রায় ২১ শতাংশের যোগানদাতা।

স্পেনের পর্যটনশিল্প বহুলাংশে নির্ভর করে কাতালোনিয়ার ওপর। প্রতি বছর স্পেনে বেড়াতে আশা পর্যটকের প্রায় ৮০ শতাংশই আসে কাতালোনিয়ার রাজধানী ফুটবলের নগরী বার্সেলোনায়। এছাড়া কৃষি উৎপাদন, শিল্পক্ষেত্র ও বার্সেলোনার সমুদ্রবন্দর স্পেনের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এবার কাতালোনিয়ার অতীত ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা যাক। স্পেনের এ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্য কাতালোনিয়া ১১৬৪ সাল পর্যন্ত একটি শক্তিশালী, সমৃদ্ধ ও স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল।

পরে যুক্ত হয় আরাগন রাজ্যের সঙ্গে। পরে ১৪৬৯ সালে আরাগনের রাজা ফারদিনানন্দ ও স্পেনের রানি ইসাবেলার বিবাহ মিলনের মাধ্যমে স্পেনের সাথে অারাগন ও কাতালোনিয়ার মিলন ঘটে।

পরে আস্তে আস্তে কাতালোনিয়াকে স্পেন তার কেন্দ্রীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর স্পেনের রাজা পঞ্চম ফিলিপ কাতালোনিয়াকে পুরোপুরি কব্জা করেন এবং এরপর থেকে কাতালোনিয়া স্পেনের অংশ হিসেবে পরিচিত হয়।

স্বদেশি সেনাদের আত্মত্যাগ ও পরাজয়কে স্মরণে রাখতে কাতালানরা তাই ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় দিবস পালন করে। বর্তমানে এই দিবসেই স্বাধীনতা দাবিতে তাদের বেশি সোচ্চার হতে দেখা যায়।

এ বছরও বার্সেলোনা শহরের প্লাসা কাতালোনিয়া দশ লাখেরও অধিক স্বাধীনতাকামী কাতালানদের এক হয়ে সমাবেশ করতে দেখা গেছে। কাতালোনিয়া পুরোপুরি স্পেনের নিয়ন্ত্রণে চলে আসার পর থেকে তারা নিজেদের স্বকীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভাষা চর্চার স্বাধীনতা হারাচ্ছে বলে ক্ষোভ জমতে থাকে কাতালানদের মনে।

পরে স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর সময়ে (১৯৩৯-১৯৭৫) কাতালানদের ওপর নিপীড়নের চরম আকার ধারণ করে।

উল্লেখ্য, ১৮৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনাও কাতালানদের স্বাধীনতার আইকন হিসেবে ব্যবহার করে।

ফ্রাঙ্কোর সময়ে ফুটবল ক্লাব বার্সাকে সামনে রেখে কাতালানরা তাদের জাতিসত্তার দাবিকে পৃথিবীর কাছে জানান দিয়েছে। এ সময় বার্সা ক্লাবের খেলোয়াড় ও পরিচালনা বোর্ড অনেক সময়ই সামরিক শাসক কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছে।

এরই রেশ ধরে এখনো বার্সা-মাদ্রিদের মধ্যে অনুষ্ঠিত ‘এল ক্লাসিকো’ সারা পৃথিবীর ফুটবলপ্রেমীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে।

জেনারেল ফ্যাঙ্কোর মৃত্যুর পর কাতালোনিয়ার জাতীয়তাবাদ আবার শক্তিশালী হতে শুরু করে এবং তীব্র আন্দোলন ও দাবির মুখে ১৯৭৮ সালের সংবিধানের আওতায় ওই অঞ্চলের স্বায়ত্ত্বশাসন ফিরিয়ে দেয়া হয়।

এছাড়া স্পেনের সংসদে ২০০৬ সালে একটি আইন প্রণয়ন করে কাতালোনিয়াকে একটি আলাদা ‘জাতি’ হিসেবে স্বীকৃতিও দেয়া হয়। কিন্তু এর সঙ্গে স্বায়ত্বশাসিত কাতালোনিয়া প্রশাসনের অনেক অধিকার খর্ব করার অভিযোগ আসে।

তাদের অনেক ক্ষমতা স্পেনের সাংবিধানিক আদালত বাতিল করলে সেটা কাতালোনিয়ার স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। স্বায়ত্বশাসনের কাটছাঁটের ফলে ক্ষুব্ধ কাতালানবাসীর সঙ্গে যুক্ত হয় ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দায় তাদের উপর আরোপিত বাড়তি করের প্রভাব।

২০০৭ থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দার ফলে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্রতার নীতি তাদের স্বাধীনতার সুপ্ত বাসনাকে আরও উজ্জীবিত করে দেয়।

২০১০ সালে কাতালানরা কেন্দ্রীয় সরকারকে ৬১ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ইউরো কর দিতে হয়েছে, অথচ তারা আদায় করেছে ৪৫ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ইউরো। এই বিষয়টি কাতালানদের মনস্তত্বে যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে, সেটা তাদের স্পেন থেকে পুরোপুরি আলাদা হয়ে যাওয়ার বাসনাকে আরও তীব্র করেছে।

কাতালানরা জোরালোভাবে বিশ্বাস করে, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে বিপুল অর্থ চলে না গেলে অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারতো। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে কাতালানরা দেখেছে, তারা পুরোপুরিভাবে স্বায়ত্বশাসনের অঙ্গীকার পেলেও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন হয়।

আর তাই কাতালানরা এখন কথিত স্বায়ত্বশাসনে (তাদের ভাষ্য অনুয়ায়ী) না থেকে স্পেন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে ইউরোপের বুকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নিতে চায়।

সর্বশেষ গণভোটকে কেন্দ্র করে কাতালানদের সাম্প্রতিক আন্দোলন অন্য যে কোনো সময়ের থেকে বেশি সংঘবদ্ধ মনে হয়েছে। এই আন্দোলনে কাতালান যুবকশ্রণির অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক।

ধারণা করা হচ্ছে, গণভোটকে বানচাল করতে কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর নীতির নেতিবাচক প্রভাব কাতালান জাতীয়তাবাদকে আরও উজ্জ্বীবিত করবে এবং এতে স্বাধীনতার দাবি আরও তীব্র হবে। আর তাতে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে পৃথিবীর মানচিত্রে কাতালানরা সত্যিই ‘কাতালোনিয়া’ নামের কোনো রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারবে কি না সেটা ভবিষ্যতই বলে দেবে।

লেখক : প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিকmiron.nazmul@gmail.com

কেএ/এমএস