মতামত

এভ্রিলের দায় নেবে কে?

মা-বাবার দেয়া নাম ছিল জান্নাতুল নাঈম আমেনা। তিনি এখন এভ্রিল নামেই পরিচিত। এভ্রিল অল্প বয়সেই মোটরবাইক চালানো শেখেন। এরপর ধীরে ধীরে তা শখে পরিণত হয়। মোটরসাইকেল নিয়ে বিভিন্ন নৈপুণ্য দেখাতে পারদর্শী তিনি। এ যানকে ঘিরেই পেয়েছেন নানা খ্যাতিও।

Advertisement

বাংলাদেশের হাইস্পিড লেডি বাইক রাইডার হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে তার। মোটরবাইকের বিখ্যাত ব্র্যান্ড ইয়ামাহার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর তিনি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এভ্রিল এখন আলোচনায় ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’র বিজয়ী হিসেবে। আলোচনার পাশাপাশি সমালোচিতও বলা যায়। কারণ, এ আয়োজনটিতে বিজয়ী হলেও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের প্রথম শর্তই পূরণ করতে ব্যর্থ তিনি। নিয়ম বলছে, প্রতিযোগীকে অবশ্যই অবিবাহিত হতে হবে। কিন্তু জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল তার বিয়ের কথা গোপন রেখেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এ বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।

তবে গতকাল মঙ্গলবার নিজের ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন এই তরুণী। সেখানে তিনি স্বীকার করে নেন তার বিয়ে ও ডিভোর্সের কথা। কিন্তু নিজের এ বিয়ের দায় তিনি নিতে চাননি। আঙুল তুলেছেন অশিক্ষিত পরিবার, বাল্য বিবাহে আক্রান্ত সমাজ ব্যবস্থার দিকে। তিনি বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে কোনো বাধা-বিপত্তিতে মাথা নত করিনি।

একটা ১৬ বছরের মেয়েকে তার বাবা জোর করে বিয়ে দিচ্ছে, সেই মেয়ে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছে। সেই মেয়ে এখন সাকসেসফুল। সে তার সমাজের কোনো কথা শোনেনি। আশপাশের কারও কথা কানে নেইনি। তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, যেখানে ২০ কোটি মানুষের বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ একটি দৈনন্দিন ঘটনা, সেখানে বাল্যবিবাহ আমি মানতে পারিনি।’ এভ্রিল আরও বলেন, ‘১৬ বছর বয়সে বিয়ে দিলেই কোনো মেয়ের বিয়েটা হয় না। সেটা বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য। আমি চেয়েছিলাম এ বিয়ের বিরুদ্ধে কাজ করতে।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার উদাহরণ টেনে এভ্রিল বলেন, মেয়েরা চাইলে অনেক কিছু করতে পারে।

Advertisement

এদিকে জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে তিনি নিজের বিয়েকে অবৈধ দাবি করে বলেন, ‘আমাকে আমার বাবা মাত্র ১৬ বছর বয়েসে বিয়ে দিয়েছিলো। সেই বিয়ে আমি মেনে নেইনি। আমি সবসময় স্বপ্ন দেখেছি পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবো। তাই সেই বিয়ের শেকল ভেঙ্গে আমি সংগ্রাম করে আজ এতদূর এসেছি। আমি অনেক আগেই বিজ্ঞজনদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছি, বাংলাদেশে আইন মোতাবেক আমার বিয়ে সিদ্ধ নয়। সুতরাং আমার ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ নির্বাচিত হওয়াটিও কোনোভাবেই অবৈধ হতে পারে না। আমার এই জয় অবৈধ হলে দেশের আইন প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সবাই তো সচেতন, নারীদের শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে নানা কথা বলে বেড়ান। তবে আমার এই জয়টিকে নিয়ে এত জল ঘোলা কেন করলো কিছু গণমাধ্যম? কেন কিছু না জেনে বুঝেই সবাই আমাকে নিয়ে সমালোচনায় মেতে উঠলেন। আমি জানতাম আমার বিয়ের আইনগত বৈধতা নেই। তাই আমি এই আয়োজনে এসেছি। নইলে আসতাম না। আমি বিশ্বাস করেছি এই প্লাটফর্মটি একজন নারীকে তার সংগ্রাম ও প্রাণশক্তিকে সাপোর্ট দেবে। তারপরও আয়োজকরা আমাকে বাদ দিতে চাইলে সেটা আমি মেনে নিবো।’

এদিকে কাল ফেসবুকে এভ্রিলের ভিডিও প্রকাশের পর থেকেই দেশের মানুষের ধারণা পাল্টে গেছে। যারা বিয়ের বিষয়টি লুকিয়ে এই আয়োজনে অংশ নেয়ায় এভ্রিলকে প্রতারক বলছিলেন তারাই এখন সাধারণ একটি কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমেনা থেকে এভ্রিল হয়ে উঠার গল্পটিকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিচ্ছেন। অনেকে এভ্রিলকে দৃষ্টান্ত করছেন দেশের অবহেলিত, শিক্ষা বঞ্চিত, বাল্য বিবাহের শিকার হওয়া মেয়েদের উৎসাহ যোগাতে।

নানা তর্ক-বিতর্কে এভ্রিলকে নিয়ে যখন আলোচনা তুঙ্গে তখন সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে এই প্রশ্ন- স্বপ্নবিলাসী সংগ্রামী তরুণী এভ্রিলের দায় নেবে কে? বাল্য বিবাহ আইনগতভাবে বৈধ বিশ্বাস করে যে মেয়েটি সুন্দরী প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের দেশ ও দেশের নারীদের প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন দেখেছিলো তার উপর কতোটা দায় চাপানো যায়? এ দায় চাপানো কতোটা হবে যৌক্তিক, নৈতিক?

Advertisement

দায় যদি এভ্রিলের থাকে তবে ১৬ বছরের একটি মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য তার পরিবারেরও দায় থেকে যায়। শাস্তি হওয়া উচিত বালিকা বিয়ে করা সেই স্বামী ও তার পরিবারের। দায় থেকে যায় ওই এলাকার সবগুলো মানুষের, স্থানীয় সরকারের দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিদের। এভ্রিলকে আকাশ থেকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলার আগে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা হবে কী? দায় থেকে যায় ‘লাভেলো মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’র আয়োজক অন্তর শোবিজ ও অমিকন এন্টারটেইমেন্টের। কারণ, আয়োজক হিসেবে তাদেরও উচিত ছিলো বিশ্বজুড়ে মর্যাদাপূর্ণ সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাওয়া সকল প্রতিযোগীর জীবন বৃত্তান্ত অনুসন্ধান করা।

যেহেতু তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এভ্রিল এখানে অংশ নিয়েছে এবং বিজয়ী হয়েছে তার মানে আয়োজকদের আসলে কোনো যোগ্যতাই নেই এই ধরনের আয়োজন করার। কেননা, এভ্রিল যেমন এখানে অংশ নিয়ে আয়োজনের প্রথম শর্ত ভেঙ্গেছে তেমনি আয়োজকরাও তাদের প্রতিযোগিতার প্রথম শর্তটি যাচাই বাছাই করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবুও কেন সবকিছুর দায় কেবল এভ্রিলকেই দেয়া হচ্ছে।

যে মেয়েটি আয়োজকদের ঘোষণামতেই সেরার মুকুট নিয়ে গণমাধ্যমে হাসিমুখে ছবি দিয়েছে, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে, কোটি কোটি মানুষের অভিনন্দন পেয়েছে সেই মেয়েটি হঠাৎ করে পতিত হলো। তার মানসিক যে বিপর্যয় ঘটেছে তা কী সামলে নিতে পারবে সে? আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক আর সমালোচনা প্রবণ সমাজে কোনো মেয়ে কী তারে পারে? কতটুকু পারে? সুন্দরী প্রতিযোগিতার মুকুট নয়, এভ্রিলের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্বাভাবিক একটি জীবন। যদি তা সে না পায়, দায় থেকে যাবে আমাদেরই। আমার, আপনার; সবার।

এলএ/এইচআর/আইআই