মতামত

এভ্রিল কি বিচ্ছিন্ন কেউ?

আমার অভিজ্ঞতায় দিস্তা দিস্তা নাম আছে। এই নামের মানুষ গুলো এখন তারকা-মহাতারকা। শুধু দৃশ্যমাধ্যম বা বিড়ালহণ্টন মঞ্চে নয়, সমাজের নানা মঞ্চে তারা প্রতিষ্ঠিত। তাদের ঈর্ষণীয় ক্যারিয়ার অনুসরণীয়, অনুকরণীয়। এই নাম গুলো বদলে ফেলেছে তাদের অতীত। তাদের সঙ্গে কোন অতীত নেই। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সত্য।

Advertisement

জীবনের যে গন্তব্যে তারা যেতে চেয়েছে, সেখানে অতীতকে গায়েমেখে যাওয়া সম্ভব নয়। এই তাদের বিশ্বাস। তাই ভুলে যেতে চেয়েছে তারা জন্মবৃত্তান্ত, সাকিন বা ঠিকানা। শুধু শেকড় উপরে ফেলেছে তারা তাই নয়, জীবনের এক মাইলফলক থেকে পরের মাইলফলকে যেতে নিকট অতীতকে মুছে দিয়েছে আকাঙ্খার ডাস্টার দিয়ে। অতীতের সঙ্গে যদি পথে দেখা হয়, তাহলে বিব্রত হন তারা।

এই তারকা-মহাতারকা বা সুশীলারা নিজেদের মতো করে অতীতের গল্পটি রচনা করে নিয়েছেন। যখন যেখানে যেমন করে গল্পটি বলা দরকার তেমন করে সম্পাদনাও করে নেন। আসলে করপোরেট উপনিবেশের প্রজা হিসেবে টিকে থাকতে হলে আপসের প্রথম শর্ত বুঝি অতীতকে মুছে দেয়ার বীরত্ব। করপোরেট, পণ্যের বাজার আর দৃশ্যমাধ্যমের পর্দায় এই বীরত্ব আমরা হরহামেশাই দেখি। সেই বীরদের কেউ আমাদের ছোট্ট গন্ডির নিকটজন আবার কেউ সমষ্টির। এই বীরদের যখন কেউ একজন নারী বলে সমাজ জানে, তখনই সরগোল শুরু হয়। ঘৃণার প্রস্তর নিক্ষেপ কেবল নারীর দিকেই। এখন যেমন প্রস্তর নিক্ষেপে রক্তাক্ত জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল।

এভ্রিল ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ নামক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। গোল বাঁধে তখন যখন চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার দিন উপস্থাপিকা অন্য একজন প্রতিযোগীর নাম ঘোষণা করার পর, আবার এভ্রিলের নাম ঘোষণা করা হয়। কেঁচো খুঁড়ার শুরু তখন থেকেই। কেঁচো খুঁড়তে গিয়েই এভ্রিলের একটি অতীত পাওয়া গেল। এই অতীত দেখে সমাজের চমকে উঠার কথা নয়। গড়পড়তা এমন গল্প এই সমাজে সুলভ। আশপাশের যেকোন মানুষের জীবনপাতা উল্টালেই পাওয়া যাবে।

Advertisement

এই মেয়েটিও এসেছে অজপাড়া গাঁ থেকে। এভাবে অনেক পুরুষেরও আগমন ঘটেছে, ঘটছে। তার একটি বিয়ের কাহিনী ছিল। সেটি বাল্যকালে। তার অমতে। সেখান থেকে নিজে পালিয়ে চলে আসে। তারপর নিজের জীবনকে নিজে লিখে নিতে চায় নিজের মতো করে। নতুন গল্প লিখতে গিয়ে অতীতের খেরোপাতা ছিঁড়ে ফেলেছিল মেয়েটি। তারপর এভ্রিল হয়ে উঠে সমাজের এক দুরন্ত তরুণী। গল্পটি খুব চেনাচেনাই ঠেকবে। আমাদের অনেকের সঙ্গে মিলেও যেতে পারে। সমাজ হুমড়ি খেয়ে পড়লো মেয়েটির অতীতের ছিঁড়ে ফেলা খেরো পাতার উপর। কিন্তু তাদের মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন ছিল, মিসওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার যে আয়োজন বসানো হয়েছিল ঢাকায়, সেটি কতোটা আন্তর্জাতিকক মান রাখতে পেরেছিল। বিজয়ী যাচাই-বাছাই থেকে শুরু করে আয়োজনের অগোছালো দিকটি সমালোচনায় এলো কতোটুকু?

‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়ে দীর্ঘ লেখা যাবে। ভোগের দুনিয়া শুধু নারীকেই ভোগ্যপণ্য বানিয়ে তৃপ্ত হয়নি। এই দুনিয়ায় পুরুষও ভোগের পণ্য। পুরুষতান্ত্রিকতা সেই সত্যটি বারবার আড়াল করতে চেয়েছে। প্রতিরোধ হিসেবে ভোগের পণ্য হিসেবে নারীর দিকে চেয়ে থাকছে অপলক। নারী প্রতিবাদ করলে তার দিকে কুৎসা, ঘৃণার প্রস্তুর ছুঁড়ে দেয়া হচ্ছে। পুরুষ কিংবা নারী উভয়েরই একটি উপলব্ধিতে পৌঁছাতে হবে- ভোগের সুপারশপে উভয়েই সাজানো আছে পাশাপাশি। দামেও খুব একটা বেশকম হয় না। তবে কেন শুধু ঠুকাঠুকি? আজকাল অনেক পণ্যের মোড়কেই তার উৎপাদন ইতিহাস আড়াল করে রেখে, শুধু মোড়কিত হবার আদ্যোপান্ত দেয়া হয়। মানুষ পণ্যের আলমারিতে থেকে, এই অভ্যাসের বাইরে থাকবে কি করে? সুতরাং স্মরণে থাকা দরকার-এভ্রিল, আমার-আপনার চেয়ে বিচ্ছিন্ন কেউ নয়।

লেখক : বার্তা প্রধান, সময় টিভি।

এইচআর/আইআই

Advertisement