মতামত

সুন্দরী প্রতিযোগিতা : নারীর সম্মান না অবমাননা?

বর্তমান সময়টাই যেন প্রতিযোগিতার। সারা বিশ্ব সেই দৌড়ে সামিল। নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা প্রমাণ করতে পারলে আপনি টিকে থাকবেন, নয়তো ঝরে পড়বেন। সেই প্রতিযোগিতারই একটি অংশ ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতা’।

Advertisement

এখন কথা হচ্ছে উল্লেখিত এই ‘সুন্দরী’ শব্দটি কিসের ভিত্তিতে ঠিক করা হয়? সৌন্দর্য’র সংজ্ঞা মূলত কী? উইকিপিডিয়া বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুন্দরী প্রতিযোগিতা ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ এর ফাইনালে অংশগ্রহণের জন্য প্রত্যেক প্রতিযোগীকে তার নিজ দেশের পদক অথবা বিশেষ রূপরেখার মাধ্যমে মিস ওয়ার্ল্ড ন্যাশনাল প্রিলিমিনারি বিজয়ী হতে হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এবারের ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার শুরুর আগে আবেদনপত্রের শর্তগুলি ছিল এরকম- বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণে আগ্রহী মেয়েকে অবশ্যই বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী নাগরিক হতে হবে, অবিবাহিত হতে হবে, সন্তান থাকা যাবে না, এবং বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ২৭ এর মধ্যে হতে হবে।

১৯৫১ সালে যুক্তরাজ্যের এরিক মোর্লে ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ প্রতিযোগিতা শুরু করেন। বিকিনি প্রতিযোগিতার বিপরীতে মেধা, দেহ সৌষ্ঠবের এই প্রতিযোগিতাটি ক্রমেই বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠে। সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ আয়োজকরা ব্যয় করেন হতভাগ্য শিশুদের কল্যাণে। এখন কথা হলো, যে নারীর মেধা ও সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে জনকল্যাণমূলক কাজ করা হয়, সেই নারীই এখানে কতটুকু সম্মান পাচ্ছেন! মানুষের মেধা, শারীরিক সৌন্দর্য যদি মানুষের কল্যাণে আসে তবে ক্ষতির কিছু নেই। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতায় আবেদন করতে হলে ‘অবিবাহিত হতে হবে, সন্তান থাকা যাবে না’- এই শর্ত দুটি নারীর জন্য কতটা সম্মানজনক? একজন নারীর পরিপূর্ণতা মেলে তার মাতৃত্বে। মহাবিশ্বের সবকিছুই সৃষ্টি হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। আর এই মানুষের বিস্তার ঘটছে নারীর মাধ্যমে।

নারীর গর্ভে পরিপূর্ণতা পাচ্ছে মানবদেহ, নারীর মমতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে মানবজনম অথচ মিস ওয়ার্ল্ডের মতো বিশ্বমানের প্রতিযোগিতায় বলা হচ্ছে- নারীর সন্তান থাকা যাবে না, বিবাহিত হতে পারবে না! এখন কথা হচ্ছে, বিয়ে হলে কি একজন নারী তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে? অথবা সন্তান জন্ম দিলে কি তার মেধা বা সম্মান কমে যায়? প্রতিযোগিতার মূল লক্ষ্য যদি হয় নারীকে সম্মান জানানো, তার মেধা আর সৌন্দর্যকে কাজে লাগানো তবে সেক্ষেত্রে এই শর্তগুলো দেয়া কতটুকু যৌক্তিক? নাকি মেধা আর সৌন্দর্য’র আড়ালে নারীকে যৌন পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করাই মূল লক্ষ্য?

Advertisement

১৯৫১ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতায় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে আমরা বিজয়ী হিসেবে দেখতে পাই ২০০১ সালে। আগবানী ডেরিগো নামের মেয়েটি প্রমাণ করেছিল সৌন্দর্য মানে গায়ের ফর্সা রঙ নয়। এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে তারা শুধু গায়ের রঙকেই সৌন্দর্য’র অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে বিচার করে আসছিলেন? যে প্রতিযোগিতার মূল শর্তই থাকে নারীকে অবিবাহিত হতে হবে, সন্তান থাকা যাবে না- তারা কিভাবে নারীর সঠিক মর্যাদা নিশ্চিত করবে?

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা নিয়ে বেশ হইচই হচ্ছে। এর বেশ কয়েকটি কারণের একটি হচ্ছে ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন যে নারী, তার বিয়ে হয়েছিল। এবং সেই বিয়েটি টেকেনি। বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েটি আইনগতভাবে সেই সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন। এখন অনেকেই দাবি করছেন তথ্য গোপনের অপরাধে বিজয়ী মেয়েটির মুকুট কেড়ে নেয়া হোক। কথা হলো, যে সম্পর্কটির অস্তিত্বই নেই, মেয়েটি কেন সেই সম্পর্কের কথা উল্লেখ করবে? মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল তার মানে তিনি এর আগে একজনের শয্যাসঙ্গী হয়েছিলেন। প্রতিযোগিতার শর্তটি আসলে কী? প্রতিযোগিতায় আসার আগে কোনো পুরুষের শয্যাসঙ্গী হওয়া যাবে না? তাহলে কি আয়োজকরা মনে করেন, নারীর সৌন্দর্য নির্ভর করে তার ‘কুমারিত্বে’? তবে তো ধর্ষণের শিকার কোনো নারীও এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবেন না!

বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নারীকে সম্মান জানানোর এই যদি হয় পন্থা, তবে ভেবে দেখার সময় হয়েছে নারীর সম্মান মূলত কোথায়! সুন্দরী প্রতিযোগিতার নামে নারীকে যৌন পণ্য হিসেবে উপস্থাপনের যে এই কৌশলী ষড়যন্ত্র- সময় হয়েছে এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। নারীর মেধা, বুদ্ধিমত্তাকে পায়ে দলে শুধু তার ‘কুমারিত্বের’ওপর ভিত্তি করে যে প্রতিযোগিতা হয়, প্রত্যেক সচেতন নারীর উচিত সেই প্রতিযোগিতাকে বর্জন করা। নারীকে প্রমাণ করা জরুরি যে তার সৌন্দর্য নির্ভর করে তার মেধা, তার জ্ঞান, তার শিক্ষায়। সৌন্দর্য কখনো গায়ের রঙ আর ‘কুমারিত্বে’ থাকে না। নারীর সৌন্দর্য পরিস্ফুটিত হোক তার মস্তিষ্কের ব্যবহারে, যৌনাঙ্গের ব্যবহারে নয়।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

Advertisement

এইচআর/পিআর