মতামত

একটি মৃত্যু সংবাদ, ঢাকার গণপরিবহন এবং কিছু প্রশ্ন?

গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ মতিঝিলে বাসে ওঠার সময় চাকার নিচে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। কিছু গণমাধ্যমে খুব ছোট্ট করে ছাপা হয়েছে সাধারণ পথযাত্রী মো. নাসিম এর মৃত্যু সংবাদটি। চলন্ত বাস থেকে নামতে অথবা উঠতে গিয়ে মৃত্যু সংবাদের তালিকায় কেবল একটি নতুন নাম যুক্ত হল। এর বাইরে এই সংবাদের আর কোন প্রতিক্রিয়া হবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কোন সাড়া ফেলবে না। একটি সংখ্যা বড়জোর ভিতরের সাদাকালো পাতায় এক কলামের সংবাদ হয়েই শেষ হয়ে যাবেন মো. নাসিম।

Advertisement

বর্ধিষ্ণু নগরী ঢাকার বেশিরভাগ মানুষই গণপরিবহন নির্ভর। একটি পরিসংখ্যান বলছে প্রতিদিন ঢাকায় প্রায় এক কোটি মানুষ বিভিন্ন কাজে রাস্তায় বের হন এবং এদের মাত্র ৪-৫ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন। অর্থাৎ ৯৫ শতাংশ মানুষকেই গণপরিবহনের উপর নির্ভর থাকতে হয়।

ঢাকার বিভিন্ন রূটে যে কতগুলো কাউন্টার সার্ভিস ভিত্তিক বাস চলে সেগুলোতে যাত্রী সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে বাসে উঠেন। বাকি যত বাস আছে সবগুলোতেই প্রায় দৌড়ে উঠতে হয়। আর পিক আওয়ার গুলোতে এই দৌড়ের সাথে যুক্ত হয় হ্যান্ডেল ধরার যুদ্ধ। প্রতিদিনের যারা বাসের যাত্রী বাসে উঠতে বা নামতে গিয়ে ছোট বা বড় দুর্ঘটনার শিকার হননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। প্রায় প্রতিটি বাস স্টপেজে ট্রাফিক পুলিশ বা ডিএমপি পুলিশ থাকেন। কোন কোন বাস স্টপেজে থাকে কমিউনিটি পুলিশও। তাদের মূল লক্ষ্য থাকে যানজট কমানো। কোথাও কোথাও তো তারা বাসগুলোকে দাঁড়াতে দেয় না। ফলে উপায়হীন যাত্রীরা আরো দ্রুত দৌড়ে বাসে উঠেন। নারী, শিশুদের জন্য বাসে ওঠা এসময় প্রায় অসম্ভব।

বাস থেকে নামার চিত্রও প্রায় একই রকম। চলন্ত বাস থেকে নামেন অসংখ্য যাত্রী। কখনও কখনও আবার হেলপার প্রায় ঠেলা দিয়ে ফেলে দেন যাত্রীদের। ছোট ছোট দুর্ঘটনা থেকে মৃত্যুর কারণও হয়ে দাঁড়ায় যেখানে সেখানে চলন্ত বাস থেকে ওঠা বা নামা। রাতারাতি এই নগরের গণপরিবহন ব্যবস্থা পাল্টে দেয়া সম্ভব না। রাতারাতি আরো নতুন রাস্তা তৈরি সম্ভব না।

Advertisement

রাতারাতি যানজট কমিয়ে ফেলা সম্ভব না। কিন্তু একটা সভ্য দেশে সভ্য মানুষদের নিয়ে সারিবদ্ধভাবে নির্দিষ্ট স্থান থেকে বাসে ওঠা নামা করার অভ্যাস তৈরি করা সম্ভব না এটা মানা কষ্টকর। যতদূর জানি ক্যান্টনমেন্ট এলাকাগুলোর ভেতরে লাইনে দাঁড়িয়ে যথাস্থানে বাস থেকে নামা ওঠা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং সকলেই তা মেনে চলছে। তাহলে সারা শহরে এই নিয়ম করতে বাধা কোথায়?

দায়িত্বে নিয়োজিত ট্রাফিক পুলিশ, বাসের চালক এবং সহকারী আর যাত্রীদের একটু সদিচ্ছা হলেই কিন্তু সম্ভব। লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে ওঠার এই অভ্যাস করতে নতুন কোন খরচেরও প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোঃ নাসিমের এক কলামের মৃত্যু সংবাদ থেকে জানলাম তিনি ১৩৩ গোপীবাগ চতুর্থ লেনে পরিবার নিয়ে থাকতেন। মো. নাসিমের মৃত্যু সবার জন্য এক কলামের সংবাদ, একটি সংখ্যা বা একটি আফসোস হলেও এটা তার পরিবারের জন্য মহাবিপর্যয়। কেবল লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে ওঠা নামার মত একটি ছোট্ট পদক্ষেপ নিলে আগামীতে হয়ত কোন পরিবারকে রক্ষা করা যাবে এই বিপর্যয় থেকে। রক্ষা পাবে একটি জীবন। একটি পদক্ষেপেই যদি একটি জীবন একটি পরিবারকে নিরাপদ রাখার একটা উপায় বের হয় তাহলে সেই পদক্ষেপটা নিতে বাধা কোথায়? সেই পদক্ষেপ নেওয়ার কোন যথাযথ কর্তৃপক্ষ কি আমাদের নগরীতে নেই?

লেখক : জনসংযোগ কর্মকর্তা।

Advertisement

এইচআর/আইআই