জাতীয়

ধানের এত দাম, লাভ হলো কার?

এবার ধানের দাম যেন আকাশছোঁয়া। ধানের এত দাম এর আগে আর কেউ কখনও দেখেননি। দেশের বিভিন্ন হাটবাজার ও মোকামে এবার সর্বোচ্চ দামে ধান বিক্রি হয়েছে। ধানের দাম অবশেষে বাড়ল, যখন কৃষকের ঘরে ধান নেই।

Advertisement

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মৌসুমের সময় সব ধান ক্রয় করেন মহাজনরা। ধানের দাম বাড়ায় এখন তাদের পোয়াবারো। ধান ও চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, তাদের ব্যবসায়িক জীবনে ধানের এত দাম কখনও দেখেননি।

কথা হয় বগুড়ার ধুনট উপজেলার চরপাড়া গ্রামের চাল ব্যবসায়ী মজিবর রহমানের সঙ্গে। ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন তিনি। ধান কিনে তা সিদ্ধ করে শুকিয়ে চাল তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেন। ধানের দাম নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ধান ও চালের এত দাম জীবনে প্রথম দেখলাম। এবারই প্রথম এক মণ আটাশ ধান ১৪০০ টাকায় কিনেছি। এ ধান থেকে চাল তৈরি করে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি।

তিনি আরও বলেন, একই ধান এক বছর আগে কেনা হয় ৮০০-৯০০ টাকায়। তখন চাল বিক্রি করেছি ৪০-৪২ টাকা কেজি দরে।

Advertisement

এবার এক মণ আটাশ ধান ১৩৮০ থেকে ১৪০০ টাকা, বিআর-২৯ ধান ১৩৫০, বিআর-৫৬ ধান ১২০০, বিআর-৫৮ ধান ১১৫০, হীরা ধান ১০০০, কাজললতা ১১০০ ও স্বর্ণলতা ১১২০ টাকা দরে কেনা-বেচা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ধানের দাম বেশি হলে স্বাভাবিকভাবে চালের দামও বেশি হয়। আগের বছর আটাশ ধানের সর্বোচ্চ দাম ছিল ৯০০ টাকা মণ। অন্যসব ধানের দাম ৭০০-৮০০ টাকার মধ্যে ছিল।

একই গ্রামের কৃষক আকিমুদ্দিন শেখ ধানের দাম প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ধানের দাম কম পাওয়ায় এবার আবাদ কম করেছি। লস (লোকসান) করে কী আবাদ করব? ফলে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার ধানের উৎপাদন কম, দামও বেশি।

‘এবার উৎপাদন কম হওয়ায় দাম বেশি। আগামী বছর কৃষকরা ভালো দামের আশায় ফের উৎপাদন বাড়াবেন। কিন্তু উৎপাদন বাড়লে তো দামও কমবে। আসলে কৃষক কখনও ভালো দাম পান না। কৃষকের কষ্টের দাম মধ্যস্বত্বভোগীরা খেয়ে যায়’- যোগ করেন তিনি।

Advertisement

গত কয়েক বছরে ধানের দাম সরকারি ও বেসরকারিভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১০ সালে ধান ক্রয়ের জন্য সরকার মূল্য নির্ধারণ করেছিল প্রতি কেজি ১৭ টাকা। সে হিসাবে এক মণ ধানের দাম ছিল ৬৮০ টাকা। ২০১১ সালে সরকারের ধান কেনার কোনো রেকর্ড নেই। তবে চাল কেনা হয় প্রতি কেজি ২৯ টাকায়। বেসরকারি পর্যায়ে ওই বছর ধানের দাম ছিল প্রতি মণ ৭০০-৭২০ টাকা। ২০১২ সালে সরকারি রেট অনুযায়ী প্রতি মণ ধানের দাম ৭২০ টাকা, ২০১৩ সালে ৭২০, ২০১৪ সালে ৮০০, ২০১৫ সালে ৮৮০, ২০১৬ সালে ৯২০ এবং ২০১৭ সালে সরকার ধানের দাম নির্ধারণ করে ৯৬০ টাকা। সেই ধান এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩০০-১৪০০ টাকা মণ।

দেশের অনেক স্থানে আউশ ধান কাটা শুরু হওয়ায় এখন নতুন ধান মণপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে।

কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, সরকারিভাবে ধান সংগ্রহের জন্য যে প্রক্রিয়া প্রয়োজন তাতে কৃষকের কোনো লাভ হয় না। কারণ সরকারি গুদামে ধান দিতে হলে যে গ্রেডে ধান শুকাতে হয় সেটা কৃষকের জানা থাকে না। এছাড়া সরকারি ধান ক্রয়ের প্রক্রিয়া ধীরগতি হওয়ায় অনেক কৃষক সে সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেন না। কারণ নতুন ধান বাড়িতে আসার সঙ্গে সঙ্গে পাওনাদাররা চাপ শুরু করেন। ফলে বাধ্য হয়ে বাজার যাচাই না করেই ধান বিক্রি করে দিতে হয়।

এছাড়া পরবর্তী ফসল ফলাতে এবং সাংসারিক যাবতীয় ব্যয় মেটাতে যে খরচ প্রয়োজন তা ধান বিক্রির টাকা থেকেই আসে। ফলে সরকারের নির্ধারিত মূল্যের কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন কৃষকরা। আর এ সুযোগ নেন মধ্যস্বত্বভোগী ও মহাজনরা। তারা কম দামে ধান কিনে গ্রেড অনুযায়ী তা পরিচর্যা করে গুদামে সংরক্ষণ করেন। পরে সময় ও সুযোগ বুঝে সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সরকারি গুদামে সরবরাহ করেন। অর্থাৎ মধ্যস্বত্বভোগী ও বড় বড় মহাজনের লাভের পাল্লা সব সময় ভারী হয়।

উত্তরাঞ্চলের চালের সবচেয়ে বড় মোকাম শেরপুর। এখানকার চাতাল মালিক আইয়ুব আলী জাগো নিউজকে বলেন, আটাশ ধান এবার প্রতি মণ ১৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এছাড়া বিআর-২৯ ধানও প্রতি মণ ১৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এবার মৌসুমের শুরুতে চাতালের জন্য আটাশ ও বিআর-২৯ ধান ৭০০-৮০০ টাকা মণ দরে কিনেছি। একই ধান তিন মাস পর মণপ্রতি আমরা ১৩০০-১৪০০ টাকায় কিনতে বাধ্য হয়েছি।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ধানের এত দাম আগে আর কখনও দেখিনি। বড় বড় মহাজন ও মজুদদারের সিন্ডিকেটের কারণে আমরা ছোট ব্যবসায়ীরা বলির পাঁঠা হচ্ছি।

এফএইচএস/এমএআর/আইআই