ভ্রমণ

মিষ্টি জলে রোদ-বৃষ্টির খেলা

যতদূর চোখ যায়- শুধু পানি। চোখ জুড়িয়ে যাওয়া স্বচ্ছ পানি। হাতের আজলা ভরে মুখে নিয়ে চমকে উঠতে হবে! এত বড় জলরাশি অথচ পানি তো মিষ্টি! বলছিলাম দেশের সর্ববৃহৎ ও এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি হাকালুকি হাওরের কথা।

Advertisement

বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা ছেড়েছিলাম মৌলভীবাজারের উদ্দেশ্যে। লক্ষ্য ছিল মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতে ভিজে নিজেকে তৃপ্ত করা। প্রথমেই বাঁধে বিপত্তি। শুক্রবার ও পূজার ছুটির কারণে সব বাস কাউন্টার ছিল টিকিটশূন্য। মহাখালী, কল্যাণপুর ঘুরে হাজির হলাম সায়দেবাদ বাসস্ট্যান্ডে। বহু কষ্টে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে খুঁজে বের করলাম মৌলভীবাজার যাওয়ার একটি টিকিট। এত কষ্ট করার কারণ ছিল একটাই, ঘুরতে যেতেই হবে!

টিকিট পাওয়ার পর শুরু হলো অপেক্ষার পালা। বাস ছাড়বে সেই রাত সাড়ে ৯টায়। সাড়ে ৯টায় বাসে ওঠানো হলো সব যাত্রী। কিন্তু বাস ছাড়লো প্রায় পৌনে ১১টায়। এত কষ্টের পরও মনে কিছুটা আনন্দ, যাওয়া তো হচ্ছে মাধবকুণ্ড।

আরও পড়ুন- দেখে আসুন সমুদ্র দ্বীপ শিপচর

Advertisement

বাস মৌলভীবাজার পৌঁছল ভোররাতে। আগে থেকেই ঠিক করা জায়গায় বাকিটা রাত বিশ্রাম নিলাম। ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেল। উঠেই ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম। সিএনজি ঠিক করলাম মাধবকুণ্ডের উদ্দেশ্যে। কিন্তু খানিকটা দূর যাওয়ার পর জানা গেল, বন্যার জন্য রাস্তা খুবই খারাপ। যাওয়াটা ঠিক হবে না। নিরুপায় হয়ে মন কিছুটা খারাপ করেই সিএনজিওয়ালাকে বললাম, ‘তাহলে হাওরের দিকে চলেন।’ মনে হচ্ছিল- হাওরে গিয়ে খুব একটা ভালো লাগবে না। তাই পথটুকু ঝিমুতে ঝিমুতেই গেলাম। ট্যুরে আসার আনন্দটা ততক্ষণে উড়ে গেছে।

হাওরের যত কাছে যেতে থাকলাম, তত বিস্মিত হতে থাকলাম। এমন সৌন্দর্য না দেখেই কী করে আমি ফিরে যেতে চাইছিলাম। হাওরের পাড়ে যেতে যেতে দুপুর। তাই ট্রলারে ওঠার আগেই ‘পেটপূজাটা’ সেরে নিলাম। খেলাম বিশেষ ধরনের মাংস ছাড়া ‘বিরিয়ানি’। যা তৈরি হয় পোলাও চাল ও চটপটির ডাল দিয়ে। সাথে থাকে ছোলা ভূনা এবং পিঁয়াজু। খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই রওনা দিলাম হাওরের মাঝে অবস্থিত পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের দিকে। সারিবদ্ধ ট্রলার। নির্ধারিত ভাড়ায় এক ঘণ্টার জন্য রিজার্ভ করলাম।

যখন ট্রলারে উঠলাম; তখন মাথার ওপরে প্রচণ্ড রোদ। দূরে ভারতের পাহাড়গুলো ঢেকে যাচ্ছিল কালো মেঘে। ট্রলার ঠিক যখন হাওরের মাঝে; তখনই পুরো আকাশ অন্ধকার করে শুরু হলো বৃষ্টি। সাথে প্রচণ্ড বাতাস। মনে হচ্ছিলো, ট্রলারটা এখনই উলটে যাবে। কিন্তু দৃশ্য বদলাতে সময় লাগলো না। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রকৃতি শান্ত হয়ে ঝলমলে রোদ উঠলো স্বচ্ছ জলের বুকে। দূরের পাহাড় স্পষ্ট হয়ে উঠলো খোলাচোখে। তারচেয়েও স্পষ্ট হয়ে উঠলো ওয়াচ টাওয়ার।

আস্তে আস্তে ট্রলারটি থামলো ওয়াচ টাওয়ারের সিঁড়ির গোড়ায়। প্রচণ্ড ঢেউ এসে বার বার আছড়ে পড়ছিল সিঁড়ির ওপর। মনে হচ্ছিলো, কোন সমুদ্রের ঢেউ এসে ছিটকে পড়ছে। আস্তে আস্তে উঠে গেলাম উপরে। আর চোখ মেলে চারিদিকে তাকানোর পর মনে হলো, এ যেন প্রকৃতির এক ভয়ংকর সুন্দর রূপ। যা চোখে দেখতেও হয়তো ভাগ্য লাগে।

Advertisement

আরও পড়ুন- প্রকৃতির মায়ায় জড়ানো মহামায়া ইকো পার্ক : শেষ পর্ব

সেখান থেকে ফিরে এলাম আবারও তীরে। ‘মন ফিরে যেতে নাহি চায়, তবু ফিরে যেতে হয়’ টাইপ অবস্থা তখন আমার। তবুও ফিরতে হয়েছে নিরুপায় হয়ে।

হাকালুকি হাওরের নামকরণ নিয়ে নানা জনশ্রুতি রয়েছে। কথিত আছে, বহুবছর আগে ত্রিপুরার মহারাজা ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘লুকি দেয়’ অর্থাৎ লুকিয়ে থাকে। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে কালক্রমে ওই এলাকার নাম হয় ‘হাঙ্গর লুকি বা হাকালুকি’। এ-ও বলা হয় যে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচণ্ড এক ভূমিকম্পে ‘আকা’ নামে এক নৃপতি ও তাঁর রাজত্ব মাটির নিচে তলিয়ে যায়। কালক্রমে এই তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নাম হয় ‘আকালুকি বা হাকালুকি’। আরও শোনা যায় যে, একসময় বড়লেখা উপজেলার পশ্চিমাংশে হেংকেল নামে একটি উপজাতি বাস করত। হেংকেলদের বসবাস এলাকার নাম ছিল ‘হেংকেলুকি’। পরবর্তীতে এই হেংকেলুকিই ‘হাকালুকি’ নাম ধারণ করে। অন্য একটি জনশ্রুতি অনুযায়ী, একসময় হাকালুকি হাওরের কাছাকাছি বসবাসরত কুকি ও নাগা উপজাতি তাদের ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করে ‘হাকালুকি’। হাকালুকি অর্থ লুকানো সম্পদ।

হাকালুকি হাওরের আয়তন ১৮১.১৫ বর্গ কিলোমিটার। হাওরটি ৫টি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত। হাওরের ৪০% বড়লেখা, ৩০% কুলাউড়া, ১৫% ফেঞ্চুগঞ্জ, ১০% গোলাপগঞ্জ এবং ৫% বিয়ানীবাজার উপজেলার অন্তর্গত।

হাকালুকি হাওরের বিশাল জলরাশির মূল প্রবাহ হলো জুরী এবং পানাই নদী। এ জলরাশি হাওরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। বর্ষাকালে হাওর সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে বিশাল রূপ ধারণ করে। এ সময় পানির গভীরতা হয় ২-৬ মিটার।

হাকালুকি হাওরে প্রায় ২৩৮টি বিল রয়েছে। প্রায় সারা বছরই বিলগুলোতে পানি থাকে। বিলগুলো হচ্ছে- চাতলা বিল, চৌকিয়া বিল, ডুল­া বিল, পিংলার কোণা বিল, ফুটি বিল, তুরাল বিল, তেকুনি বিল, পাওল বিল, জুয়ালা বিল, কাইয়ারকোণা বিল, বালিজুড়ি বিল, কুকুরডুবি বিল, কাটুয়া বিল, বিরাই বিল, রাহিয়া বিল, চিনাউরা বিল, দুধাল বিল, মায়াজুরি বিল, বারজালা বিল, পারজালা বিল, মুছনা বিল, লাম্বা বিল, দিয়া বিল ইত্যাদি।

আরও পড়ুন- পাহাড়ি ঝরনার সঙ্গে একদিন : শেষ পর্ব

একদিনের ছুটি নিয়ে কর্মব্যস্ত জীবন থেকে স্বস্তির জন্য অবশ্যই ঘুরে আসতে পারেন এ জলের স্বর্গে। কারণ কর্মব্যস্ত জীবনে কিছুটা মুক্তিরও প্রয়োজন আছে সবার। সে জন্য ঢাকার সব বাসস্ট্যান্ড থেকেই মৌলভীবাজারের সরাসরি এসি বা ননএসি বাস ছাড়ে। মৌলভীবাজার পৌঁছে সিএনজি যোগে পৌঁছে যেতে পারবেন সরাসরি হাকালুকি হাওরে।

এমএএন/এসইউ/পিআর