জীবন ও কর্ম দিয়ে যারা দেশকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে যান তারাই একটি দেশের সত্যিকারের তারকা। তারাই অনুপ্রেরণা, জাতির ক্রান্তিকালে সঙ্কট মোকাবেলার সাহস জোগান। অন্যসব মাধ্যমের মতো শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে জড়িত মানুষেরাও দেশ ও দেশপ্রেমকে ধারণ করে নন্দিত হয়ে থাকেন।
Advertisement
ফলে একদিকে যেমন তারা দেশের মানুষের কাছে অকৃত্রিম ভালোবাসা পান, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও লাভ করেন। একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ নানা সম্মান দিয়ে রাষ্ট্র তাদের সম্মানিত করার চেষ্টা করে। অভিনয়, সংগীত, নৃত্য, সাহিত্যসহ সংস্কৃতি চর্চার সবক’টি শাখাতেই এখন পর্যন্ত অসংখ্য সফল শিল্পীরা এসব পদকে ভূষিত হয়েছেন।
পাশাপাশি দেশের বিশেষ নাগরিক হিসেবে অনেকরকম সুবিধাদিও পান তারা। শিক্ষা, বাসস্থানের সুযোগসহ রোগে-অসুখে পান সরকারি সহায়তাও। এ নজির কম নয়। তালিকায় আসবে সাবিনা ইয়াসমিন, লাকী আখন্দ, আজম খান, লেখক, চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ, কাঙ্গালিনী সুফিয়া, আজিজুর রহমান, কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বার, গীতিকবি নয়ীম গহরসহ বহু কালজয়ীদের নাম।
এসব মানুষদের অনেকেই ছিলেন যথেষ্ট সচ্ছল। তবুও রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করতে, তার কৃতী সন্তানদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পাশে দাঁড়িয়েছিল। রাষ্ট্রীয় পদক পাওয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো সরকারের দায়িত্বই। সেক্ষেত্রে কোনোরকম সমালোচনা বা তথ্য অনুসন্ধানের প্রয়োজন পড়ে না।
Advertisement
কিন্তু আজকাল সরকারি সাহায্যের বিষয়টি হয়ে উঠছে শিল্পাঙ্গনের মানুষদের জন্য বিব্রতকর অভিজ্ঞতার। অনেকেই গুরু-গম্ভীর এ বিষয়টিকে খুব সহজ বানিয়ে ফেলছেন, যার ফলে রাষ্ট্রীয় সম্মানের ব্যাপারটি জৌলুস হারাচ্ছে। ম্লান হচ্ছে যোগ্য মানুষদের অর্জন। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে বিরূপ ধারণা।
সাধারণত সরকারের পক্ষ থেকে বেশিরভাগ সময়ই শিল্পীদের সহায়তা দেয়ার নির্দেশ বা তত্ত্বাবধানের আদেশ আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। ইতিহাস ঘাটলে দেখো যায়, বঙ্গবন্ধু কন্যা ছাত্রজীবন থেকেই একজন সংস্কৃতিপ্রেমী। তিনি যেমন গাইতে পারেন, লিখতেও পারেন চমৎকার। সেইসব প্রমাণ জাতি অনেকবারই পেয়েছে। স্বভাবতই একজন প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্বেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন ও জানেন দেশের অধিকাংশ সফল সংস্কৃতিকর্মীদের। কারো কারো সঙ্গে রয়েছে তার ব্যক্তিগত পরিচয় ও সখ্যও।
বলা যায় অকপটে, খোলসের বাইরে শেখ হাসিনা আপাদমস্তক একজন সংস্কৃতিসেবীও। তার শাসনামলে তুলনামূলক ভালো থাকে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনও, দাবি করেন সংস্কৃতি কর্মীরা। তাই দেশের আর সবার মতো এই অঙ্গনের মানুষরা তাদের কোনো কিছু প্রয়োজনে, আপদে-ব্পিদে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান। তিনিও চেষ্টা করেন সবার দাবি পূরণ করতে। তাই ভরসার জায়গাটি হয়েছে মজবুত।
কিন্তু সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে এর অপব্যবহার করছেন অনেকেই। সামান্য কোনো একটা অসুখে বা বিপদে পড়লেই সবাই প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হচ্ছেন। তার সাহায্য কামনা করছেন। একে সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নমনীয় ভাবনা, তার উপর অসুখে সাহায্য চাওয়াটা মানবিক ব্যাপার। এসব নিয়ে তাই কেউ কথা বলেন না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে গেল কয়েক মাসে বিষয়টি সমালোচিত হচ্ছে প্রচুর। অনেকেই দাবি করছেন, কোনো শিল্পীকে সহায়তা দেয়ার আগে এর সঠিক পর্যালোচনা করা জরুরি। এর জন্য সরকার ও সংস্কৃতি অঙ্গনের সিনিয়রদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি বা এরূপ কিছু একটা সেল গঠন জরুরি।
Advertisement
নাম না প্রকাশ করার শর্তে চলচ্চিত্রের সিনিয়র এক অভিনেত্রী এই প্রতিবেদকের কাছে বলেন, ‘একটা সময় ছিলো যখন সবাই আমাদের সম্মান করতো। আমাদের নিয়ে সাধারণ মানুষদের আগ্রহের শেষ ছিলো না। কিন্তু নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আমরাই পুরো শিল্পী সমাজকে হেয় করে চলেছি। মানুষ এখন তারকাদের জীবনযাপন নিয়ে হাসে, মজা করে।’
তিনি বলেন, ‘কিছু একটা হলেই মিডিয়া কভারেজ আর প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য কামনা করা শিল্পীদের অনেক সস্তা করে তুলেছে। হাতে একটু কেটে গেলেও এখন অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য কামনা করছেন। অথচ, যিনি সাহায্য চাইছেন তার নিজের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান খুবই ভালো। ফলে যারা তাকে চেনেন তাদের কাছে বিষয়টি বিব্রতকর লাগে। পুরো শিল্পী সমাজ হীনম্মন্যতায় ভোগে। এইসব মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসা উচিত। আমি চল্লিশ বছর ধরে চলচ্চিত্রে আছি। আল্লাহর রহমতে অর্থকড়ির অভাব আমার নেই। যদি আমার একটা কিছু হয়ে যায়, আমি যদি নিজে সেটা সামাল দিতে না পারি তখন রাষ্ট্র নিশ্চিই তার দায়বদ্ধতা থেকে আমার পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু আগ বাড়িয়ে আমার হাত পাতার কিছু নেই।
সাবিনা ইয়াসমিনকে দেশের মানুষ যেভাবে ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছে সেটা নজিরবিহীন। সাবিনা ইয়াসমিন বা তার পরিবার কিন্তু কারো কাছে হাত পাতেনি। এই সমাজই অনুভব করেছে তার পাশে দাঁড়ানো উচিত। এই উপলব্দিতে সম্মান আছে। শিল্পীদের আর যাই হোক, সম্মানের জলাঞ্জলি দিলে চলে না।’
তিনি বলেন, ‘নিজের সামর্থ্য থাকার পরও সরকারের কাছে সাহায্য চেয়ে সেই টাকা ভোগ করা এক ধরনের প্রতারণা। আর প্রতারণা একটি জঘন্য অপরাধ। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের অর্থ আসে দেশের মানুষের পকেট থেকে। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাসের জায়গা থেকে শিল্পীদের পাশে দাঁড়ান। কিন্তু প্রতারণা করে সেই টাকা নিলে দেশের টাকা লুট করার অপরাধই হয়।এতে প্রকৃত সাহায্যপ্রার্থীও বঞ্চিত হয়। শিল্পী সমাজের কাছে কেউ এটা প্রত্যাশা করে না।’
প্রবীণ এক সংগীতশিল্পীও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত বলে জানালেন। তবে এ বিষয়ে নাম প্রকাশ করে কিছু বলতে চাননি। তিনি বলেন, ‘আজকাল অনেককেই দেখছি সামান্য জ্বর হলে পত্রিকায় বিরাট অসুখ দাবি করে খবর প্রকাশ করছেন। সেগুলো দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্য কামনা করছেন। একজন শিল্পী কখনো এমন ছোট মানসিকতার হতে পারেন না। অভিযোগ শুনি, ঢাকায় ফ্ল্যাট বাড়ি রেখে অনেকেই এখানে সেখানে হাত পাতেন মানবিকতার আবেগ বিক্রি করে।
অনেকে আবার সরকারি সাহায্য এনে ছেলে মেয়ের ধুমধাম করে বিয়ে দেন, জুয়া পর্যন্ত খেলেন। বর্তমান সরকার যথেষ্ট আন্তরিক এই দেশের সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে। সেই সুযোগের অপব্যবহার করা ঠিক নয়। এতে করে শিল্পীদের মূল্যায়ন কমে যায়। শিল্পের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা চলে যায়। বর্তমানে যা হচ্ছে। সবখানেই প্রচুর সমালোচনা শুনি। ব্যাপারটা এমন ঠেকেছে, সত্যি যার সাহায্য প্রয়োজন তার জন্য সাহায্য চাইতেও লজ্জা লাগে। লোকে ভাবে নতুন ধান্ধা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আবার এখানে উল্টোটাও ঘটে থাকে। অনেকেই আছেন যারা নানা ক্ষেত্রে কিংবদন্তি। কিন্তু রাজনৈতিক আদর্শে ভিন্নতা থাকার জন্য তারা প্রধানমন্ত্রীর সহানুভূতি পান না। তারা নিজেরাও হয়তো চক্ষুলজ্জায় চান না, কেউ তাদের হয়ে চানও না। এইদিকেও সরকারের নজর রাখা উচিত। ব্যক্তির দল থাকে, মত থাকে। কিন্তু শিল্পী সবার।’
অনেকের দাবি, এই বিব্রতকর পরিস্থিতি ঠেকাতে সরকারের উচিত আরও আন্তরিক হওয়া। যে কোনোরকম সাহায্যের আগে অনুসন্ধান করে নেয়া, আসলে কী জন্য কতটুকু সাহায্য প্রয়োজন। শিল্পী বড় না ছোট, এই দলের না ভিন্ন দলের সেই ভাবনার চেয়ে এটাই বেশি জরুরি।
কেউ কেউ মত দিয়েছেন, চিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্য না দিয়ে চিকিৎসার ভার নিজেই বহন করতে পারে সরকার। যেমনটি ছিলো পপগুরু আজম খান, গায়ক লাকী আখান্দ, গীতিকবি ও লেখক নয়ীম গহরের ক্ষেত্রে। সরকার তাদের বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করিয়েছে। কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বারের বেলাতেও এমনটা হয়েছে। নির্দিষ্ট কাউকে দায়িত্ব দিয়ে তদারকি করাতে পারে।
আর যদি কোনো শিল্পী আর্থিক সাহায্যের আবেদন করেন তবে তার আবেদনটি আমলে নিয়ে যাচাই বাছাই করতে সরকার ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষদের সমন্বয়ে একটি সেল গঠন করা যেতে পারে। সেই সেল অনুসন্ধান করে রিপোর্ট দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এলএ/এইচআর/পিআর