তখন দুপুর, রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ হিতৈষী সংঘের চার তলার বারান্দায় বসে আকাশ পানে চেয়ে আছেন এক বৃদ্ধা মা। গভীরভাবে কী যেন ভাবছিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মা কেমন আছেন?। পিছনে ঘুরে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিলেন, ভালো আছি বাবা। বললেন আরেকবার বলতো মা কেমন আছেন?, মা ডাকটা অনেক দিন শুনি না।
Advertisement
আজ ১ অক্টোবর, আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। ‘আগামীর পথে প্রবীণের সাথে’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে এ বছর পালিত হচ্ছে দিবসটি। ‘প্রবীণ দিবসে প্রবীণ নিবাসে কেমন আছেন?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে অনেক দিন মা ডাক না শোনা এই মা বললেন, শুধু বাড়ির কথা মনে পড়ে, ছেলের কথা মনে পড়ে, রাতে ঘুম আসে না। তখন ছেলের ছবি দেখি, ছবির সঙ্গে কথা বলি।
নিজের কথা বলতে গিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই মা বলেন, আমাদের সংসার জীবনটা খুব সুখের ছিল। স্বামী চলে যাওয়ার পর ছেলে বিয়ে করে। তাদের একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়েও আছে। ছেলে আমার রিয়েল স্টেট ব্যবসা করে। কতো মানুষকে বাড়ি বানিয়ে দেয়, কিন্তু আমার ছেলের বাসায় আমারই থাকারই জায়গা নেই। যে বয়স হয়েছে আমি তো এখন বোঝা। ছেলের বউ আমাকে পছন্দ করে না। তাইতো আমি যেন ভালো থাকি তাই এখানে দিয়ে গেছে আমার ছেলে। বেশ ভালোই আছি আমার কোনো কষ্ট নেই।
ছেলের স্মৃতিচারণ করে এই মা বলেন, ছোটবেলায় আমাকে ছাড়া ছেলে ঘুমাতে পারতো না। মাঝে মাঝে ঘুম থেকে ওঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকতো।
Advertisement
আমার কলিজার টুকরো ছেলে এখন খুব ব্যস্ত মানুষ, মায়ের কথা তার মনেই পড়ে না। কখনও আমি কল দিলে বলে ‘মা ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলছি। আমি অপেক্ষায় থাকি, কিন্তু সে আর কল দেয় না। তবে এখানে থাকা-খাওয়ার খরচ ঠিক সময় মতই পাঠিয়ে দেয়। সব মিলিয়ে খুব ভালো আছি, খুব…।
নিবাসের আরেকটু ভেতরে যেতেই বাম পাশের রুম থেকে বার্ধক্যজনিত খুব কাশির শব্দ শোনা যায়। ভেতরে যেতেই দেখা মিললো ষাটোর্ধ্ব এক মা বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন।
আলাপকালে তিনি বলেন, কিছুদিন ধরে খুব অসুস্থ। আপনার ছেলেরা খোঁজ নিতে আসেনি? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বলেন, সে তো অনেক দূরে থাকে, তাই আসতে পারেনি। কিছুটা অভিমানী কণ্ঠে জানালেন, তার মা যে অসুস্থ এটা জানলে নিশ্চয় আসতো। খুব ব্যস্ত থাকে তো, তাই ইচ্ছে করলেও আসতে পারে না।
আলাপকালেই রুমের দেয়াল ভরে থাকা অনেকগুলো সাদাকালো ছবিতে চোখ পড়তেই তিনি সেগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। এর মধ্যে আছে তার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছবিসহ ছেলে আর স্বামীর ছবি।
Advertisement
জানান, স্বামী যোসেফ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পরিচালক ছিলেন। বেশ কয়েক বছর হলো মারা গেছেন। একমাত্র ছেলে পড়ালেখা করে আমেরিকায়। রাজধানীর দিলুরোডে তাদের নিজস্ব বাসা আছে। সেটা এখন ভাড়া দেয়া। তার সঙ্গে থাকার মতো কেউ নেই। তাই ছেলে তাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছেন।
তিনি বলেন, শেষ জীবনে ছেলে-বউ, নাতি-নাতনির সঙ্গে থাকতে মন চায়। কিন্তু ভাগ্য তা নেই, তাই এখানে থাকতে হচ্ছে। সব সময় ছেলের কথা মনে পড়ে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। এই যে এখন অসুস্থ অবস্থায় আছি এ সময় ছেলে আমার সেবা করবে এটা সব মায়েরই চাওয়া। কিন্তু ছেলে আমার সব সময়ই খোঁজ খবর নেয়। ছেলে আমাকে খুব ভালোবাসে…..।
এই বৃদ্ধা মায়ের রুম থেকে বের হতেই দেখা মিললো মধ্য বয়সী এক ভদ্রলোকের। ঘুরে ঘুরে তিনি প্রবীণ নিবাসে থাকা মানুষের খোঁজ নিচ্ছেন।
আলাপকালে জানান, তার নাম এরশাদ আলী, পেশায় ব্যবসায়ী। ছোট বেলাতেই বাবা-মা হারিয়েছেন। বাবা-মা’র ভালোবাসা কী জিনিস তা পরিপূর্ণভাবে দেখা হয়নি। তাই সময় সুযোগ পেলে মাঝে মাঝে বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে গিয়ে এসব প্রবীণ মানুষের খোঁজখবর নেন।
তিনি বলেন, খুব কম বাবা-মারই সৌভাগ্য হয় সন্তানদের আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক বাবা-মা সন্তানদের সঙ্গে থাকলেও সে থাকাটা পুরনো আসবাবপত্রের মতো এক কোণে পড়ে থাকা। ছেলের সময়ও হয় না তাদের খোঁজ-খবর নেয়ার। তবুও এসব বাবা-মার অভিশাপ, অভিযোগ, অনুযোগ কিছুই থাকে না। শুধু তারা চায় শেষ জীবনে এক সঙ্গে আনন্দ, খুশিতে সময় কাটাতে। কিন্তু কয়জনের ভাগ্যে এমন হয়? তবুও তারা চুপ থাকেন সব সময়। আমার বাবা-মা নেই তাইতো মাঝে মাঝে প্রবীণ নিবাসে থাকা এসব মানুষের খোঁজ নিতে আসি।
এএস/এমএমজেড/এআরএস/আরআইপি