সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন ছবি প্রায়ই দেখা যায়। তারপরও এই ছবিটার প্রতি দৃষ্টি না পড়ে উপায় নেই। খুঁটিতে বাঁধা একটি কিশোর। রক্তাক্ত। মাথাটা ঝুলে পড়েছে নিচের দিকে। পা ভাঙা। রক্তাক্ত পোশাক। সবুজ ঘাসের উপরও ছড়িয়ে আছে তার রক্ত।
Advertisement
সাগর নামে এই কিশোরকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। কেন? কী তার অপরাধ? তার সবচেয়ে বড় অপরাধ সে দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাই তার উপর চুরির অপবাদ দেওয়া খুবই সহজ। তারপর তাকে পিটিয়ে মারাও কঠিন কোন কাজ নয়। গৌরীপুরে এক কাশবনে পড়েছিল তার হাতপা বাঁধা মৃতদেহ। তাকে পিটিয়ে মেরেছে স্থানীয় হ্যাচারির মালিক আক্কাস আলি, তার ছেলে এবং তাদের লোকজন। সাগর একটি বস্তিতে থাকতো। ভাঙারির ব্যবসা করতো। যেমন তার বয়সী আরও অনেক কিশোর করে থাকে। দরিদ্র এই শিশু কিশোররা প্রাণপণে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যায় দুবেলা দুমুঠো খাবারের আশায়।
প্রায়শই এই শ্রেণির শিশু-কিশোরদের যে কোন ছুতায় মারধোর করা হয়। স্থানীয় একটু ক্ষমতাবান লোকরা এদের চোর বলে অভিহিত করে। চুরির অপবাদ অথবা ‘বেয়াদপ’ অপবাদে এদের উপর যখন তখন নেমে আসে নির্যাতন। কখনও দুচারটে চড় থাপ্পর কিল ঘুষি। কখনও আবার ঘোরতর নির্যাতন। এমনকি একটু ধনী অন্য কোন শিশু কিশোরের সাথে বন্ধুত্ব পাতানো, অথবা কথাকাটাকাটি কিংবা কোন অবস্থাপন্ন ঘরের কোন মেয়ের সঙ্গে একটু কথা বললেও এদের উপর নির্যাতনের পাহাড় নেমে আসতে পারে। প্রতিদিন অসংখ্য দরিদ্র শিশু কিশোর এমন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
মনে পড়ছে এমন নির্যাতনে হত্যার শিকার কিশোর রাজন ও রাকিবের কথা। রাজন ছিল তরকারি বিক্রেতা। রাকিব একটি কারখানার শ্রমিক। তাদের দুজনেরই মূল অপরাধ ছিল তারা দরিদ্র। রাজন রাকিবের পর আরও অনেক শিশু কিশোরকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। যদিও দুর্ভাগ্যবশত তারা ফেসবুকে আলোচিত হতে পারেনি বলে তাদের মৃত্যু চাপা পড়ে গেছে অন্য অনেক ঘটনার আড়ালে। একইভাবে অনেক গৃহকর্মী শিশু কিশোরও নির্যাতনের ও হত্যার শিকার হয়েছে।
Advertisement
প্রশ্ন হলো মানুষের মধ্যে এমন নৃশংস প্রবৃত্তির চর্চা আর কতকাল অব্যাহত থাকবে? আর কতদিন এভাবে তুচ্ছ কারণে বা কোন কারণ ছাড়াই এই দরিদ্র শিশু কিশোররা নির্যাতনের শিকার হবে? আর কতকাল তারা এমনিভাবে হত্যার শিকার হবে? আর কতদিন তাদের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকবে পথে ঘাটে কাশবনে?
আমাদের দেশে আইনের হাত এত খাটো যে প্রভাবশালীরা প্রায়শই তার নাগালের বাইরে রয়ে যায়। দরিদ্র মানুষকে হত্যা বা নির্যাতন করে পার পাওয়া কোন ব্যাপার নয় প্রভাবশালীদের কাছে। তাদের হত্যাকাণ্ড প্রায়ই অপমৃত্যু নাম নিয়ে খারিজ হয়ে যায় হত্যামামলা থেকে। গৃহকর্মী শিশু কিশোরের উপর চালানো নির্যাতনও এভাবে চোখ এড়িয়ে যায় আইনের।
নজরুল সাম্যবাদী কবিতা লিখেছিলেন সেই কবে। গত শতকের প্রথম দিকে। আর প্রায় একশ বছর পেরিয়ে এখনও ধনীর হাতে মার খেয়ে প্রাণ হারাচ্ছে দরিদ্র মানুষ।
নিহত সাগরের বাবা তার সন্তানের হত্যার বিচার চেয়েছেন। কিন্তু এই সমাজের কাছে বিচার চেয়ে কি কোন সত্যিকার ফলাফল পাওয়া যায়? এই তো কিছুদিন আগে শিশু মেয়েকে নিয়ে অপমানে ক্ষোভে ট্রেনের চাকায় আত্মাহুতি দিলেন দরিদ্র হজরত আালি। কি বিচার হয়েছে সে ঘটনার?
Advertisement
দরিদ্র মানুষের প্রতি যতদিন এই সমাজ নিপীড়কের ভূমিকায় থাকবে ততোদিন এমন ঘটনা চলতেই থাকবে। প্রয়োজন সকল হত্যার কড়া বিচার। প্রয়োজন প্রতিটি নির্যাতক, নিপীড়ক, হত্যাকারীকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। যে কোন সময় গরুচোর কিংবা পকেটমার সন্দেহে দরিদ্র শিশু কিশোরকে মেরে ফেলার প্র্যাকটিস কবে বন্ধ হবে? কবে সমাজের এইসব নৃশংসতা থামবে?
থামবে তখনই যখন যে লোক একটি আঘাতও বিনা বিচারে কোন মানুষকে করেছে তার কড়া শাস্তি হবে।
শিশুকিশোররা যদি চুরি বা অন্য কোন অপরাধে জড়িত হয় তাহলে তার জন্য দেশে আইন আাছে, আছে সংশোধনাগার। আছে পুলিশ। কেউ চুরি করলে তার বিচার হবে আইন অনুযায়ী। কিন্তু কথা নেই বার্তা নেই কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা কোন সভ্য দেশে চলতে পারে না।শিশু রাজনের হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। সাগরের হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে কিনা জানি না। প্রয়োজন প্রতিটি হত্যা নির্যাতন প্রতিটি ধর্ষণের বিচার। দরকার অপরাধীর কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
আরও দরকার অপরাধ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো। কারণ অনেক সময় আমাদের গ্রাম গঞ্জের একটু প্রভাবশালী বা ধনী ব্যক্তিরা মনে করে এগুলো কোন অপরাধই নয়। ক্ষমতার দম্ভে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে। দরকার তাদের এই ক্ষমতার দম্ভকে ভাঙা। দরকার তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো।
আমরা উন্নয়নের মহা সড়কে পা রেখেছি, উন্নয়নের জোয়ারে নাকি আমরা ভেসে যাচ্ছি। কিন্তু দরিদ্র শিশুকিশোরদের ভাগ্যের উন্নয়ন কবে হবে সেই প্রশ্নের জবাব কে দেবেন? আর কতকাল সাগরদের মরতে হবে এভাবে? আর কতকাল তারা শিক্ষাবঞ্চিত থাকবে? আর কতকাল ধনীর হাতে মার খাবে দুর্বল?
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/আরআইপি