বিশেষ প্রতিবেদন

রোহিঙ্গা ইস্যুতেও আমরা ঐকমত্যে আসতে পারিনি : মজিবর রহমান

‘প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে গিয়ে যত কথাই বলুক না কেন তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। সন্ত্রাস মোকাবেলার কথা বলে মিয়ানমার প্রথমে যে কথা বলেছিল আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে একমত হয়ে যৌথ অভিযানে অংশগ্রহণের কথা বলেছিলেন। উনি (প্রধানমন্ত্রী) দ্বিধার মধ্যে ছিলেন, এ কারণে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।’

Advertisement

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সারোয়ার সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে এমন মন্তব্য করেন। টানা পাঁচবারের নির্বাচিত এ সংসদ সদস্য চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেন।

‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপির তুলনায় বেশি উন্নয়ন করতে পারেনি’ দাবি করে বিএনপির এ নেতা বলেন, আইয়ুব খানও তো দেশে উন্নয়ন করেছে। সেই উন্নয়ন উপেক্ষা করেই আমাদের সশস্ত্র সংগ্রাম করতে হয়েছে। কিন্তু কেন? অধিকারের জন্য। আজ গণতন্ত্র অবরুদ্ধ। আজ মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। বিরোধী দলগুলো কথা বলতে পারছে না। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসা একটি সরকার এখন ক্ষমতায়। সরকারের উন্নয়ন আছে, আমি বলব না উন্নয়ন নেই। তবে মানুষের অধিকার না দিয়ে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা না দিয়ে, মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে যে উন্নয়ন তা মানুষ গ্রহণ করে না। মানুষ আজ উন্নয়নের পরিবর্তে নৈতিকতার উন্নয়ন চায়। তারা মানবাধিকারের উন্নয়ন চায়। মানুষ হত্যা, গুম, খুন চায় না। অস্বস্তি থেকে বাঁচতে চায়।

“মিয়ানমার ১৭ বার আমাদের আকাশসীমা লঙ্গন করেছে, তিনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি; শরণার্থীদের বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তিনি পরমুখাপেক্ষি হচ্ছেন। একটি গণতান্ত্রিক দেশ হলে এটা হতো না। আজ মানুষ বুঝতে পারে ড. অমর্ত্য সেনের সেই উক্তি, ‘গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়’। এটাই আজ বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”

Advertisement

তিনি বলেন, বর্তমান গণমাধ্যম কিছুটা হলেও রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে সরকারকে সহযোগিতা করছে। আমি বলব, দেশে এটাই হচ্ছে এখন বড় সমস্যা, আমাদের মধ্যে গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্র না থাকলে কী কী হয় সেটাও আমরা দেখতে পাচ্ছি। এসব সঙ্কট মোকাবেলা করতে গেলে সমস্যা হয়। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- রুলস অব মেজরিটি, ডিসকাশন উইথ মাইনরিটি, ডিসকাশন উইথ এভরিবডি (সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, সংখ্যালঘুদের সঙ্গে আলোচনা, সবার সঙ্গে আলোচনা)। কিন্তু যতই ক্রাইসিস (সঙ্কট) আসুক না কেন কোনোক্রমেই সরকার সবার সঙ্গে ঐক্য গড়তে চায় না। এটা হচ্ছে তাদের মনের ভয়। সবসময় তারা মসনদের কথা ভাবেন। মসনদ ঠিক থাকলে সবই ঠিক।

বরিশালের সাবেক এ মেয়র অভিযোগ করেন, রাষ্ট্রের তিন বিভাগকে চেইন অব কমান্ডের মধ্যে রাখতে পারছে না সরকার। গণতন্ত্র না থাকলে যেটি হয়। আমরা এরশাদের সময় শ্লোগান দিয়েছিলাম, ভোট হবে যেভাবে পরীক্ষা হবে সেভাবে। সে সময় এরশাদ সরকার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। গণতন্ত্রের সঙ্গে আইনের শাসন, ন্যায় বিচার, স্বস্তি, শান্তি ও প্রতিরক্ষা; দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সবকিছুই জড়িত। স্বাধীনতার রক্ষাকবচ গণতন্ত্র। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের মতো একটি পুরনো দলকে এসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত।

‘রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে প্রধানমন্ত্রী পরমুখাপেক্ষি হচ্ছেন’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, কার মুখোমুখি হচ্ছেন তা বলতে চাচ্ছি না। তিনি তাকিয়ে আছেন তারা কী করবেন। এমন সময় তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, সিদ্ধান্তটা যদি তিনি আগে নিতেন তাহলে অনেক শরণার্থী বেঁচে থাকত, তাদের বিপদে পড়তে হতো না। প্রধানমন্ত্রী যে সেভ জোনের কথা বলছেন, সেভ জোনের ইতিহাস তো উনাকে আগে জানতে হবে। বসনিয়া হার্জেগোভেনিয়ায় কিন্তু সেভ জোন হয়েছিল। সেখানে (সেভ জোন) যারা ছিল তাদের অতর্কিত গুলি করে হত্যা করা হয়। সেভ জোনের ডিসক্রিপশনটা (বর্ণনা) প্রধানমন্ত্রী দেননি। সেটা দেয়া দরকার ছিল। রোহিঙ্গারা ভালোভালে সেখানে বসবাস করুক আমরা এটা চাই। সেভ জোন করে তাদের আটকে দেয়া, নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে বন্দী রাখা- এটা কিন্তু ভালো না। পৃথিবীর যেসব জায়গায় সেভ জোন হয়েছে যেমন- আমরা হার্জেগোভেনিয়ার কথা জানি, বসনিয়ার কথা জানি, সিরিয়াসহ অন্যান্য জায়গায় সেভ জোনের ইতিহাস কিন্তু ভালো নয়। আমরা সেভ জোনের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে বলছি, তাদের (রোহিঙ্গা) নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হলো সবচেয়ে বড় বিষয়। আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

বরিশাল বিএনপির অভিভাবক হিসেবে পরিচিত এ নেতা আরও বলেন, শেখ হাসিনা ভোটে নির্বাচিত না হোক তাই বলে কি উনি ভালো কাজ করছেন না? ভালো কাজ তো করছেন। আমরা তো বলব না সব কাজই তার খারাপ। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সময়ও কিন্তু শরণার্থী ছিল। খালেদা জিয়া তাদের কূটনৈতিকভাবে ফেরত দিয়েছিলেন। কীভাবে তিনি (খালেদা জিয়া) কাজ করেছেন এর ব্যাকগ্রাউন্ড তো সরকার নিতে পারে। ১৯৭৮ সালের কথাও আমরা জানি। কফি আনানের রিপোর্ট এবং জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল সেই এগ্রিমেন্টও (চুক্তি) কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। সে সময় মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার দেয়ার কথা বলেই কিন্তু ফেরত নিয়েছিল। গ্রেটার ইন্টারেস্টের (বৃহত্তর স্বার্থ) বিষয়ে আমাদের সকলের মধ্যে ঐক্য থাকা দরকার। আমরা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাজনীতি করি কিন্তু বৃহৎ স্বার্থে আমরা একমত থাকব না, এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।

Advertisement

‘রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে চীন ও ভারতকে আমাদের পাশে পাওয়া উচিত ছিল কিন্তু আমরা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছি’ উল্লেখ করে মজিবর রহমান সারোয়ার বলেন, নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় হওয়ায় তারা আজ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমর্থন করছে না। অত্যাচার-অবিচার করার পরও তারা মিয়ানমার সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক। কারণ মানবতা গণতন্ত্রেরই একটি অংশ। আজ মানবতা উপেক্ষিত, গণতন্ত্রও উপেক্ষিত।

‘গান্ধিজীর অহিংস নীতিতে ভারত এখন আর চলছে না। নিজ দেশে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে অং সাং সু চি নির্যাতিত হয়েছিলেন। ওই সময় সারাবিশ্ব তাকে সমর্থন দিয়েছিল, তার প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছিল কিন্তু আজ তিনি সারাবিশ্বে বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। রোহিঙ্গাদের ওপর তার সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতন, রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনযাপন; মানবতা লঙ্ঘনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ আজ আমাদের চোখের সামনে। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচিত ছিল বৃহত্তর ঐক্যের ডাক দেয়া কিন্তু তিনি সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ অবৈধ সরকারপ্রধান হওয়ায় তিনি ভয় পেয়েছেন যদি তার ডাকে কেউ সাড়া না দেয়! জাতির বৃহত্তর স্বার্থে একমত না হতে পারা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।’

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের এক সঙ্কটময় মুহূর্তের কথা উল্লেখ করে বিএনপির এ নেতা আরও বলেন, কাশ্মিরের এক নেতার মুক্তির জন্য বিমান হাইজ্যাক করা হয়েছিল। বিমানে যেসব যাত্রী জিম্মি ছিলেন তাদের স্বজনরা বাইরে অনশন শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখলাম কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী সে সময় ক্ষমতাসীন যারা ছিলেন সবার সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করলেন। পরবর্তীতে সেই কারাবন্দী নেতার মুক্তি দেয়া হলো। আর বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে, সরকার কিংবা বিরোধীদল কেউই ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে না। জাতীয় সঙ্কটময় মুহূর্তে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা- এটা তো কল্পনাই করা যায় না। খুবই দুঃখজনক, এটাই বাংলাদেশের রাজনীতি।

‘চারদিকে যে অবস্থা, কিছুই ভালো লাগে না। জীবন বাজি রেখে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। পরবর্তীতে আন্দোলন-সংগ্রাম, পাঁচবার জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি। অত্যন্ত দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে। যা দেশের জন্য, আগামী দিনের স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য ভালো লক্ষণ নয়’- যোগ করেন তিনি।

সহায়ক সরকার প্রসঙ্গে মজিবর রহমান সারোয়ার বলেন, এটা একটি মিনিংফুল (অর্থপূর্ণ) ব্যাপার। সহায়ক সরকারের বিষয়টা হলো নিরপেক্ষ একটি সরকার। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা থেকে তো আমরা সরে এসেছি। সরকার বলছে এটা সংবিধানে নেই। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা থেকে সরে এসে নির্বাচনকালীন সময়ে আমরা সহায়ক সরকারের কথা বলছি।

‘সরকার যদি সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করতে চায়, তাহলে তো হবে না। নির্বাচন কমিশনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে আগামীর নির্বাচন তো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা যাবে না। সকলের জন্য যদি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না হয়; কেউ খানাখন্দে থাকবে, কেউ কোর্টের (আদালত) বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করবে আবার কেউ ভালো অবস্থায় থেকে নির্বাচন করবে- এটা তো হতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষও এমন নির্বাচন চায় না’- যোগ করেন তিনি।

এমএম/এমএআর/আরআইপি