জয়পুরহাটে হঠাৎ করে আলুর বাজার পতনে বিপাকে পড়েছেন হিমাগার মালিক, কৃষক ও আলু ব্যবসাসীরা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে জাত ভেদে প্রতিবস্তা আলুতে দাম কমেছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।
Advertisement
জানা গেছে, আলু তোলার মৌসুমে অধিক লাভের আশায় আলু বিক্রি না করে তা কোল্ড স্টোরেজে রেখে এখন চরম বিপাকে পড়েছেন এ এলাকার কৃষক ও আলু ব্যবসায়ীরা। ফলে উৎপাদন খরচসহ আনুসঙ্গিক অন্যান্য খরচ তুলতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাদের। একদিকে আলুর দাম কম অন্যদিকে বাজারে ক্রেতা সংকটের কারণে আলুর দাম ক্রমেই কমছে। ফলে লোকশানের আশঙ্কায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে হঠাৎ করে আলুর চরম মূল্য পতনের কারণে হিমাগারগুলোতে বর্তমানে কৃষক ও ব্যবসায়ীর উপস্থিতি কমতে শুরু করেছে। ফলে কৃষক ও আলু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সঙ্গে বিপাকে পড়েছেন হিমাগার মালিকরাও।
এলাকার কৃষক, ব্যবসায়ী ও হিমাগার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এবার উৎপাদন মৌসুমে অনুকূল আবহাওয়া থাকায় আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের আশায় সেসময় আলু বাজারে বিক্রি না করে এলাকার কোল্ড স্টোরেজগুলোতে সংরক্ষণ করেছে। আর তাতেই ঘটেছে বিপত্তি।
Advertisement
আবার আলু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় নিজেদের মূলধন ছাড়াও হিমাগারে সংরক্ষিত তাদের আলুর বিপরীতে মোটা অংকের ঋণ গ্রহণ করে অতিরিক্ত আরও আলু কিনে এলাকার বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করেছেন।
ফলে এ এলাকার হিমাগারগুলোতে গত বছরের তুলনায় এবার আলুর সংরক্ষণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আর এর প্রভাব পরে চলতি মৌসুমে হিমাগারগুলোতে আলুর দাম কমেছে, পাশাপাশি কমেছে আলুর আনলোডের (খালাস) পরিমাণও।
এবছর হিমাগার মালিকরা কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে সুদ ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যে কৌশলে ফাঁদ পাতে। আর হিমাগার মালিকদের পাতানো সেই ফাঁদে পা দিয়ে ঋণের টাকায় কৃষক ও আলু ব্যবসায়ীরা হিমাগারগুলোতে গত বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে অতিরিক্ত আলু সংরক্ষণ করে এখন চরম হতাশায় ভুগছেন।
সুদের টাকা ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যে হিমাগার মালিকরা আলুচাষি ও ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে হিমাগারে অতিরিক্ত আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে এখন না পারছেন আলু আনলোড করাতে; না পারছেন ভাড়া, ঋণ ও সুদের টাকা আদায় করতে। আলুর চরম মূল্য পতনের কারণে হিমাগারগুলোতে বর্তমানে কৃষক ও ব্যবসায়ীর উপস্থিতি কমতে শুরু করায় এবং ক্রেতা সংকটের কারণে বিপাকে পরেছেন হিমাগার মালিকরা।
Advertisement
এবার জয়পুরহাট জেলায় ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছে ৯ লাখ ৫০ হাজার টন। ১৬টি হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করা আছে দেড় লাখ টন।
হিমাগার মালিকরা জানান, অন্য বছরে এসময় হিমাগারগুলো থেকে মজুদ আলুর ৮৫ শতাংশ বিক্রি হত। আর যে পরিমাণ থাকতো সেগুলো কৃষকরা বীজ হিসাবে মাঠে রোপন করতো। এ বছর তার উল্টো। দাম কম হওয়ায় গত শুক্রবার পর্যন্ত ৩০ শতাংশ আলু হিমাগার থেকে বের হয়নি।
পুনট কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক বিপ্লব বলেন, মৌসুমের শুরুতে ১ লাখ ৭৫ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে।গত শুক্রবার পর্যন্ত সংরক্ষিত আলু ৩০ শতাংশ বের হয়নি। বার বার নোটিশ দেওয়ার পরও কেউ আলু তুলতে আসছেন না। মজুদ আলু নিয়ে চরম বিপাকে আছি।
কালাইয়ের শিমুলতলীর আরবি স্পেশিয়ালাইড কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা জানান, ১ লাখ ৮৯ হাজার বস্তা আলুর মধ্যে এখন পর্যন্ত বের হয়েছে মাত্র ২৬ হাজার বস্তা। আলুর উপরে নেওয়া ঋণের টাকা পরিশোধের ভয়ে কেউ হিমাগারে আসছে না।
পুনট বাজারের ব্যবসায়ী মিঠু ফকির জানান, তিনি মৌসুমের শুরুতে ১০ হাজার বস্তা আলু ক্রয় করে হিমাগারে রেখেছিলেন। বর্তমানে বাজারের যে অবস্থা, তাতে ওই আলু বিক্রি করে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে ৩০ লাখ টাকা পুঁজি হারাতে হবে তাকে। সে কারণে তিনি এখন পর্যন্ত এক বস্তা আলুও বিক্রি করেননি।
পাঁচবিবি উপজেলার শিরট্রি গ্রামের কৃষক হেলাল মণ্ডল বলেন, আমি ৫০০ বস্তা গ্র্যানুলা আলু হিমাগারে রেখেছি। প্রতি বস্তার বিপরীতে ৭৫০ টাকা ঋণ নিয়েছি। বর্তমানে আলুর যে দাম তাতে হিমাগারের ৭৫০ টাকা, ভাড়া ৩০০ টাকা ও সুদ হাজারে ছয় মাসে ৬০ টাকা মিলে ১১১০ টাকা করে বস্তা প্রতি প্ররিশোধ করতে হবে, ৩৬০ টাকা করে প্রতি বস্তার বিপরীতে আমার পকেট থেকে দিতে হবে। ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়ে আমি ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
জয়পুরহাটে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক সুধেন্দ্রনাথ রায় বলেন, হিমাগারে আলুর দাম কম হলেও খুচরা বাজারে এখনও প্রতিকেজি আলুর দাম ২৭ টাকা এবং পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের পার্থক্য অস্বাভাবিক।
রাশেদুজ্জামান/এফএ/আইআই