শিক্ষা

বেশি দামে নিম্নমানের পণ্য কিনেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর!

বেশি দাম দিয়ে নিম্নমানের ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জাম কিনেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই)। এছাড়া কেনাকাটায় চরম অনিয়মের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নেয়ারও অভিযোগ উঠেছে ক্রয়সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

Advertisement

অভিযোগ রয়েছে, পরস্পর যোগসাজশে বাজারমূল্যের বেশি দামে এসব সরঞ্জাম কিনে অসাধু পন্থায় অনেকে লাভবান হচ্ছেন। ফলে গচ্ছা যাচ্ছে সরকারি অর্থ। অথচ এসব পণ্য বেশিদিন টেকসই হচ্ছে না।

শুধু অধিদফতর নয়, বিভিন্ন মহলের যোগসূত্রে এসব অনিয়ম হচ্ছে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।

প্রসঙ্গত, সারাদেশের ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় নয় হাজার ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়ার সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

Advertisement

বর্তমানে ৫০ হাজার স্কুলে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ ল্যাপটপ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ২৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০টি জেলায় এসব সামগ্রী বিতরণ করার কথা রয়েছে। অক্টোবরের মধ্যে ৩৮ হাজার স্কুলে এসব ল্যাপটপ বিতরণ শেষ হবে।

সূত্র জানায়, ৫০ হাজার ল্যাপটপ বিতরণ নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। উচ্চদরে নিম্নমানের ল্যাপটপ ক্রয় করা হয়েছে। এ নিয়ে দরদাতাদের একজন টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ঘাপলার অভিযোগ এনে আদালতে মামলাও করেছেন।

ডিপিই অর্থ ও সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক এবং ক্রয় কমিটির সদস্য মহেশ চন্দ্র সাহা এসব অনিয়ম প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, সব নিয়ম মেনেই ৫০ হাজার ল্যাপটপ ক্রয় করা হচ্ছে। শর্ত অনুযায়ী সব ঠিক থাকলে তা বুঝে নেয়া হবে।

তিনি বলেন, দরপত্রের মাধ্যমে ক্রয় করলে সেই পণ্য বাজারদরের চেয়ে বেশি ব্যয় হয়। এ কারণে প্রতিটি ল্যাপটপ ক্রয় বাবদ ব্যয় কিছুটা বেশি হয়েছে।

Advertisement

জানা গেছে, ২০১৬ সালের প্রথম দিকে ৫০ হাজার ল্যাপটপ ক্রয়ে ডিপিই দরপত্র আহ্বান করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে আহ্বায়ক করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট অধিদফতর এবং কম্পিউটার কাউন্সিলের ছয় কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

সূত্র জানায়, এতে ১৫টি কোম্পানি দরপত্র জমা দেয়। তাদের মধ্যে কম্পিউটার সোর্স, ফ্লোরা টেলিকম, ফ্লোরা লিমিটেড, গ্লোবাল কম্পিউটার, স্মার্ট টেক বিডি কম্পিউটারকে নির্বাচন করা হয়। আটটি লটে ছয় কোম্পানিকে ৫০ হাজার ল্যাপটপ ক্রয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়।

অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে কোরআই-৭ মডেলের ল্যাপটপ বাজারে চলছে। কিন্তু ডিপিই কোরআই-৩ মডেল কিনছে। প্রতিটি ল্যাপটপ বাবদ প্রায় ৫২ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। অথচ বাজারে আধুনিক মডেল কোরআই-৭ ল্যাপটপ পাওয়া যায় ৫০ হাজার টাকায়। দুই বছর আগেও ডিপিই’র বিতরণ করা প্রায় চার হাজার ল্যাপটপ কোরআই-৫ মডেলের ছিল।

কোরআই-৭ ও কোরআই-৩ মডেলের তুলনামূলক কনফিগারেশন ও সুবিধা প্রসঙ্গে আইডিবি’র কম্পিউটার ব্যবসায়ী ও হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রায়হান মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, কোরআই-৩ পুরনো ভার্সন, যা তিন বছর আগে বহুল ব্যবহৃত ছিল। কোরআই-৭ আসার পর কোরআই-৩ ও ৫ এর ব্যবহার একেবারেই কমে গেছে।

সাধারণ মানের কাজের জন্য কোরআই-৩ উপযুক্ত কিন্তু মাল্টিমিডিয়ার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বর্তমানে কোরআই-৭ এর বিকল্প নেই। দামের বিষয়ে তিনি বলেন, কোরআই-৭ এর অর্ধেক বাজারমূল্যে এখন কোরআই-৩ পাওয়া যাচ্ছে।

তবে পুরনো মডেলের ল্যাপটপ ক্রয়ের যুক্তি দেখিয়ে মহেশ চন্দ্র সাহা বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের জন্য কোরআই-৩ ল্যাপটপই উপযোগী। এ কারণে পুরনো মডেলের ল্যাপটপ ক্রয়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়।

তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে সব ল্যাপটপ ক্রয় করা হয়েছে। বর্তমানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। অক্টোবরের মধ্যে ২০ জেলায় এসব ল্যাপটপ বিতরণ শেষ হবে।

বেশি দামে ল্যাপটপ কেনা প্রসঙ্গে ডিপিই অর্থ ও সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কিছু কিনলে মার্কেট প্রাইজের চেয়ে পণ্যের দাম একটু বেশি হয়। যেহেতু এটি ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডার তাই স্বাভাবিকভাবে এর ব্যয়ও একটু বেশি হয়েছে। এটি স্বাভাবিক ব্যয়।

বাকি স্কুলগুলোতে কবে নাগাদ ল্যাপটপ সরবরাহ করা হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে মহেশ চন্দ্র সাহা বলেন, প্রায় ১৪ হাজার স্কুলে এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎ সংযোগ পেলে পর্যায়ক্রমে বাকি স্কুলগুলোতে ল্যাপটপ সরবরাহ করা হবে।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি তিন হাজার ৯৩০টি স্কুলে ল্যাপটপ দেয়া হয়। কিন্তু এতে ব্যবহৃত সফটওয়্যার ‘জাল’ হিসেবে আপত্তি ওঠে। প্রতিটি সফটওয়্যার সিডি বাবদ ১০ হাজার টাকা করে ব্যয় দেখান হলেও এসব ল্যাপটপে ‘পাইরেসি’ সফটওয়্যার দিয়ে গছিয়ে দেয়া হয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ওইসব ল্যাপটপের প্রায় সব নষ্ট অবস্থায় স্কুলগুলোয় পড়ে আছে।

অন্যদিকে, স্কুলের জন্য আসবাবপত্র কেনার টেন্ডারেও সর্বনিম্ন দরদাতার পরিবর্তে অন্যদের কাজ দেয়ার পাঁয়তারার অভিযোগ উঠেছে। এতে সরকারের অন্তত ২০ কোটি টাকা গচ্ছা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। সর্বনিম্ন দরদাতার পরিবর্তে বেশি দরদাতাকে কাজ দেয়ার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকে পর্যন্ত অভিযোগ পড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটি ডিপিই’র কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে।

এ ব্যাপারে ডিপিই মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে কেনাকাটার টেন্ডার সম্পন্ন হয়। আগে এটি সরকারি বিভিন্ন কমিটি থেকে অনুমোদন নিতে হয়। সুতরাং নজরদারির ব্যবস্থা আছে। এরপরও ক্রয় সংক্রান্ত ফাইল এখন পর্যন্ত আমার কাছে আসেনি। এলে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।

তবে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ল্যাপটপ কেনা হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।

এমএইচএম/একে/এমএআর/জেআইএম