অন্ধকারের সিন্ধুতীরে একলাটি ওই মেয়ে
Advertisement
আলোর নৌকা ভাসিয়ে দিল আকাশ-পানে চেয়ে।
আজ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭। আজ বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ৭১তম জন্মদিন। তাঁর ৭১তম জন্মদিনে আমরা তাঁকে জানাই শুভ জন্মদিন, জানাই জন্মদিনের অভিনন্দন অভিবাদন।
শেখ হাসিনার জন্মদিনের কথা মনে পড়লে তাঁর সমগ্র জীবনের সংগ্রাম ও সাধনার প্রতিচ্ছবি আমাদেরকে আপ্লুত করে। তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাবহ আমাদের মনের পর্দা আর চোখের সম্মুখে জীবন্তরূপে ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে ভ্রান্ত ইতিহাসের অন্ধকারের যবনিকা ঠেলে জননেত্রী শেখ হাসিনা কী করে একটি জাতিকে সঠিক ইতিহাসের পথরেখায় এনে দাঁড় করিয়েছেন তারই দীর্ঘ এক মিনিয়েচার। মিথ্যার আবর্তে নিমজ্জিত হতে থাকা বাঙালিকে সত্য ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড় করানোর পরিপূর্ণ সেই ক্যানভাস আমাদের মন ও চোখের দৃষ্টি জুড়ে অনবরত তিনি প্রতিফলিত করে চলেছেন।
Advertisement
এই সংগ্রাম কোন সহজ কাজ ছিল না। সত্যনিষ্ঠ ইতিহাসের এই মিনিয়েচার-ক্যানভাসের স্রষ্টা জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনের সংগ্রামী সাধনায় ক্রমে ক্রমে আমাদের কাছে ইতিহাসের প্রকৃত সত্যকে সহজ ও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। সত্যনিষ্ঠ ইতিহাসের পথে জাতির অগ্রগতিকে ধাবমান করে তোলার জন্য আজ আমরা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস এবং সেইসঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধকে একসূত্রে দেখবার অবকাশ পাই। এদেশের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে শেখ হাসিনাই আমাদেরকে বস্তুনিষ্ঠ এক পটভূমির ওপর স্থাপন করে সেই অবকাশটুকুর ভিত্তি পুনর্নির্মাণ করেছেন। তাই তাঁর জন্মদিনের এই শুভ প্রত্যুষের মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার উদ্দেশ্য পুনরাবৃত্তি করতে চাই ‘আপনাকে শুভ জন্মদিন প্রিয় নেত্রী’।
শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর প্রথম সন্তান। প্রথম সন্তান শেখ হাসিনার জন্ম এবং তাঁর আদর-আবদারের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু পিতৃত্বের গৌরব অনুভব করেছিলেন। রাজনৈতিক কারণে জেল-জুলুমসহ সাংগঠনিক বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় পরিবারকে যথেষ্ট সময় দেওয়া সম্ভব ছিল না বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু তাঁর এই উপলব্ধির কথা ব্যক্ত করেছেন এইভাবে : ‘কয়েক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভাল করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাচিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। অনুভব করতে পারলাম যে, আমি ছেলে মেয়ের পিতা হয়েছি।’
শিশু বয়সেই বাবার খুব নেওটা ছিলেন আমাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা। বাবাকে ছাড়া কিছুই বুঝতে চাইতেন না। বঙ্গবন্ধুও শেখ হাসিনার আদর-আবদার উপেক্ষা করতে পারতেন না। তাই হাসিনার দৃষ্টির আড়ালেই ঘটতো রাজনৈতিক কারণে জাতির পিতার গৃহত্যাগের নানা ঘটনাবলি। বঙ্গবন্ধু আরেক জায়গায় লিখেছেন ‘রাতে রওয়ানা করে এলাম। দিনের বেলায় আসলে হাচিনা কাঁদবে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আদরের কন্যা শেখ হাসিাকে কাঁদাতে চাননি কখনো। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী জাতীয় এই নেতা ক্ষমতালোভীদের চক্রান্তে নিহত হলেন তারই স্বাধীন দেশে! ঘাতকের ষড়যন্ত্রে নিহত বঙ্গবন্ধুর জন্য, পিতার অপত্য আদর- স্নেহের জন্য শেখ হাসিনার অন্তর্গত অনিঃশেষ কান্না আর থামে না। শুধু শেখ হাসিনাই নন- স্বাধীনতা বিরোধী মুষ্টিমেয় নাগরিক ছাড়া সমগ্র জাতি বঙ্গবন্ধুর জন্য আজও কাঁদে নিরন্তর। বাঙালির এ কান্না কোনদিন শেষ হওয়ার নয়।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র আরেক জায়গায় লিখেছেন : ‘আমাকে দেখে রেণু আশ্চর্য হয়ে গেল। বাচ্চারা ঘুমিয়েছিল। রেণু তাদের ঘুম থেকে তুলল। হাচিনা ও কামাল আমার গলা ধরল, অনেক সময় পর্যন্ত ছাড়ল না, ঘুমালও না, মনে হচ্ছিল ওদের চোখে আজ আর ঘুম নাই।’ সেদিন রাতের গভীরে সহসা পিতৃমুখ দর্শনের আনন্দে শেখ হাসিনার চোখ থেকে ঘুম চলে গিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে শেখ হাসিনা তীব্র দুঃখের দহনে আর কী কোন দিন ঘুমাতে পেরেছিলেন? আজো কি আচম্বিতে কখনো কোন রাত্রিতে আধোঘুম আধো জাগরণে জননেত্রী সচকিত হয়ে উঠেন না! কখনো কি ঘোরের মধ্যে পিতা ভেবে অশরীরী কোন ছায়ার গলা জড়িয়ে ধরতে গিয়েও সহসা সম্বিতে ফিরে আসেন না!
Advertisement
কে জানে প্রিয় নেত্রীর দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনীর নির্ঘুম গোপন কান্নার কথা! নরপিশাচদের হাতে এমনভাবে স্বজন হারানোর পর কোন সন্তান কি পারে শান্তিতে এক মুহূর্ত ঘুমিয়ে নিতে! কেউ পারে না। বঙ্গবন্ধু এবং সকল আত্মীয়-পরিজন হারিয়ে শেখ হাসিনা অনেকটাই একা। একা, তবু দেশ ও জাতির কল্যাণে তিনিই ভাসিয়েছে ‘আলোর নৌকা’। সেই নৌকার গন্তব্য রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের মোহময়ী ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠায়। তাঁর এই অভিযাত্রায় সাফল্যের সোনার ধান ঘরে ওঠা শুরু হয়েছে নানাভাবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের গুণেই আজ আমরা মধ্যম-আয়ের দেশে প্রায়ই পৌঁছে গেছি। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পশ্চাতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সততা, দৃঢ়তা এবং দূরদৃষ্টিসহ সকল গুণের সম্মিলনই সক্রিয় দেখা যায়।
যখন একজন দেশনায়ক বা রাষ্ট্রনায়ক ‘আমার দেশের মানুষ কেমন আছে? কেমন থাকতে চায়?’- এরূপ প্রশ্ন সর্বোর্দ্ধে এবং সর্বাগ্রে বিবেচনায় রাখেন তিনি কখনোই রাজনীতির রহস্যাবৃত ও কুহকের আবরণে আবৃত কথামালায় সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করতে পারেন না। জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর তিনযুগেরও বেশি সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনে প্রচলিত রাজনীতি কুহক-আবৃত সেই পথে হাঁটেনি কখনো। বরং বঙ্গবন্ধুর ন্যায় উদার হৃদয় ও সরল মানবিক আবেগকেই তাঁর রাজনীতির অন্তর্গত পুঁজি বিবেচনায় নিয়ে প্রথমত বাঙালি জাতিকে এবং তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্বমানবের কল্যাণের লক্ষ্যে নিজেকে নিবেদন করে চলেছেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ দল হিসেবে যখন বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত তখন উত্তর-তিরিশের যৌবনে শেখ হাসিনা ঐক্যের প্রতীকরূপে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তারপর দীর্ঘ প্রায় তিনযুগের রাজনৈতিক সাধনায় ক্রমে ক্রমে আওয়ামী লীগসহ এদেশের রাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণেও সক্ষমতা দেখিয়েছেন।
১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর ইতোপূর্বের সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বে-আইনিভাবে যে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তার অপনোদনের মাধ্যমে হত্যাকারীদের অনেকেরই বিচার সম্পন্ন করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী ও দাগি আসামিদের আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ মানবিক মূল্যবোধের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইতোপূর্বেকার প্রায় পাঁচ লাখ সহ নতুন করে গত একমাসে আসা আরো প্রায় সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।
বাংলাদেশ মানেই শেখ হাসিনা। তাঁরই মানবিক সদিচ্ছায় মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদেরকে আমরা আশ্রয় দিচ্ছি। এখনো নতুন নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন-অনুপ্রবেশ ঘটছে। ধারণা করা হচ্ছে আগামী আরো কিছুদিন রোহিঙ্গা শরণার্থীর এই ঢল অব্যাহত থাকবে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের জননেত্রীর এই উদ্যোগকে বিশ্ববাসী প্রশংসা করেছে। তাকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উল্লেখ করে বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রচারণাও চালিয়েছে। অবশ্য বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার আগেই তিনি ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’র মর্যাদা অর্জন করেছেন সন্দেহ নেই। মিয়ানমার যাদেরকে ‘রোহিঙ্গা’ বলে, ‘মুসলমান’ বলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে, সেনাবাহিনীর অস্ত্রের মুখে যাদেরকে সমুদ্রবক্ষে ঠেলে দিয়েছে বিশ্বনেতা ও জননেত্রী শেখ হাসিনা তাদেরকে ‘মানুষ’ বলে বিশ্বজননীর ন্যায় বাংলাদেশের মমতাময়ী কোল পেতে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়- বিশ্বনেতার মতো বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণাও করেছেন : ‘আমার দেশের সতেরো কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারলে আট-দশ লাখ রোহিঙ্গাকেও খাওয়াতে পারবো। প্রয়োজনে আমরা তিন বেলার বদলে দুই বেলা খাবো।’ বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলে, পিতৃহৃদয়ের বিশালতা তিনি নিজেও ধারণ করেন বলে এমন ঘোষণা দিতে পারেন। সম্প্রতি শেষ হওয়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতায়ও রোহিঙ্গাসহ বিশ্বব্যাপী অবহেলিত মানবিকতার বিপর্যয়কে তুলে ধরে তা নির্মূলে জাতিসংঘের উদ্যোগ গ্রহণের বাস্তবতাকে স্পষ্ট করেছেন। যা বিশ্বের সর্বত্রই প্রশংসিত হয়েছে।
আমরা যখন শেখ হাসিনার ৭১তম জন্মদিনকে সামনে রেখে নানা রকমের ভাবনায় আচ্ছন্ন তখন শোনা যাচ্ছে এবারের শান্তিতে সম্ভাব্য নোবেল মনোনীতদের নামের সংক্ষিপ্ত তালিকার শীর্ষে আলোচিত হচ্ছে তাঁর নাম। বিশ্ব মানবের কল্যাণ ও শান্তির জন্য শেখ হাসিনা নোবেল পুরস্কার লাভ করলে আমরা খুশি হবো নিশ্চিয়ই। কিন্তু আমরা এও মনে করি যে, এই পুরস্কারটি যেসব মানবীয় গুণাবলি বা কর্মকাণ্ডের জন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ইতোপূর্বে প্রদান করা হয়েছে তাদের যে-কারো চেয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার অবদান সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অনেক অনেক বেশি। আসছে অক্টোবরেই এ পুরস্কার লাভকারীদের নাম ঘোষণা হবে। সে ফলাফল বা ভবিষ্যৎ আমরা জানি না। তবে, এরকম বোধ আমাদের অনেকের মধ্যে আছে কিংবা অনেকেই সক্রিয়ভাবে উপলব্ধি করেন যে, নোবেল কমিটি অনেক আগেই তাঁকে এ সম্মান জানাতে পারতো।
আজ আমরা এমন এক বিশ্বনেতার জন্মদিনের ঊষালগ্নে দাঁড়িয়ে যিনি বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নেতাদের অন্যতম। সাম্প্রতিককালের আলোচিত ২৪ আগস্টের হত্যা পরিকল্পনার বিতর্ক বাদ দিলেও এ পর্যন্ত তাঁকে হত্যার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে ২০বার। মানবকল্যাণ ও সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির আদর্শসহ রাজনৈতিক নানা বিষয়ে পিতৃরক্তের উজ্জ্বল উত্তরাধিকার যার রক্তকণিকায় প্রবহমান তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনা। জাতির পিতার মতো মৃত্যুভয়হীন আমাদের প্রিয় নেত্রীর মানবিক আদর্শের পদতলে তাঁরই ৭১তম জন্মদিনে পুনর্ব্যক্ত করছি রবীন্দ্রকাব্যের এই চরণ :প্রভাতসূর্য, এসেছ রুদ্রসাজেদুঃখের পথে তোমার তূর্য বাজেঅরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্ত-মাঝেমৃত্যুর হোক লয় তোমারি হোক জয়।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/আরআইপি