‘ভাইব্বিলাম, মিলিটারির (মিয়ানমার) আতত মরি যাইয়ুম, হাসিনার লাই বাঁচি থাক্কি’। কথাটির শুদ্ধ বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘ভেবেছিলাম, সেনাবাহিনীর (মিয়ানমার) হাতে মারা পড়বো, কিন্তু হাসিনার জন্য বেঁচে আছি’। এটা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এক রোহিঙ্গার ভাষ্য। (বাংলা নিউজ, ১৯ সেপ্টেম্বর)
Advertisement
আমরা দেখেছি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখতে গিয়ে সেখানে অবস্থানরত শিশুদের পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনেন। সেখানকার নারীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কান্নাজড়িত মুখ দেখার সঙ্গে সঙ্গে পা ছুঁয়ে তাকে সালাম করতে এগিয়ে যান। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা স্রষ্টার কাছে শুকরিয়া আদায় করতে থাকেন। তারা কান্নায় প্রলাপের মতো বলতে থাকেন, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের চায় না। ভিনদেশি প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেখতে এসেছেন। আল্লাহ তার মঙ্গল করুন।
শেখ হাসিনা শুধুমাত্র রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেননি, খাবারের ব্যবস্থা করেছেন, চিকিৎসা করাচ্ছেন পালিয়ে আসা আহত ও অসুস্থদের। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরে পাবার জন্য সরব রয়েছেন। আমরা সর্বশেষ দেখেছি, জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণে বেশিরভাগ অংশ জুড়েই ছিল রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ। সহিংসতা, হত্যা, নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এবং এ সমস্যা সমাধানে তিনি কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও তুলে ধরেন। যা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। এই প্রস্তাবের আলোকে জাতিসংঘ পুনরায় জরুরি সভাও ডেকেছেন। বুধবার বা বৃহস্পতিবারের সভায় শেখ হাসিনার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা হবে।
আজ এই মানবিক শেখ হাসিনার জন্মদিন। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেসা মুজিবের ঘর আলো করে ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্ম নিয়েছে তাঁদের প্রথম সন্তান হাসিনা। ভালো নাম শেখ হাসিনা। বাবা মা আদর করে ডাকতেন হাসু। কে জানত এই হাসুই হবেন একদিন তাঁর বাবার যোগ্য উত্তরসূরি? বাবার দেখানো পথে দীপ্ত পায়ে এগিয়ে দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন। এই দেশ এবং মানুষকে নিয়ে যে স্বপ্ন তাঁর বাবা শেখ মুজিবুর রহমান দেখেছিলেন সে স্বপ্নের পথে তিনি হেঁটে চলেছেন দুর্বার গতিতে।
Advertisement
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৮১ সাল অবধি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল এমনই অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল যেখানে দমনপীড়ন-শোষণ নির্যাতনে মানুষ ছিল অসহায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিদেশে থাকায় বেঁচে যাওয়া তাঁর দুইকন্যার দেশে আশা ছিল অনিরাপদ। তারপর ১৯৮১ সালের ১৭ই মে শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং তাঁর প্রতি লক্ষ লক্ষ মানুষের সেই সংবর্ধনা আমরা নিশ্চয়ই বিস্মৃত হতে পারি না। পিতার শোকের সান্ত্বনা তিনি সেদিন এই মানুষের মাঝে দেখেছিলেন এবং মনে মনে স্থির করেছিলেন পিতার অসমাপ্ত কাজ তাকেই সমাপ্ত করতে হবে এবং জীবন দিয়ে হলেও করতে হবে।
এ কথা তিনি বারবার উচ্চারণও করেছেন। তারপর ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত এক দীর্ঘ-স্বৈরাচার-সামরিক-সরকার-বিরোধী আন্দোলন করেছেন শেখ হাসিনা। নিজের দল সংগঠিত করতে হয়েছে, নেতা ও কর্মীদের মধ্যে আদর্শ স্থাপন করতে হয়েছে। আজ তিনি দেশ ও জনদরদী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। পিতার মতই অসীম সাহসী, দৃঢ়তায় অবিচল, দেশপ্রেম ও মানবিক গুনাবলীসম্পন্ন একজন আদর্শবাদী নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা মানুষের কাছে আজ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় নেতা।
একজন শেখ হাসিনা কোন পুরস্কারের আশায় কাজ করেন না; মানুষের ভালবাসাই তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। দেশের যেকোন সংকটে কিংবা সম্ভাবনায় মানুষের কাছে একটি আস্থাশীল নাম শেখ হাসিনা। জনগণের এই আস্থা তিনি কথা দিয়ে নয়, কর্ম দিয়ে অর্জন করেছেন। কারণ দেশের যেকোন সংকট সেটা প্রাকৃতিক হোক আর মানুষ্যসৃষ্ট হোক শেখ হাসিনা দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করে সমাধা করেছেন। যেমন- দেশে সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যা হয়েছে; হাজার হাজার একর ফসলী জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অথচ একটি মানুষও না খেয়ে থাকেনি। সাথে সাথে ত্রাণ নিয়ে ছুটে গিয়েছেন শেখ হাসিনা। পরবর্তী ফসল ঘরে তোলা নাগাদ বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন; পুনরায় ফসল উৎপাদনের জন্য বিনা সুদে ঋণ বিতরণ করেছেন এবং সহজ শর্তে কৃষি উপকরণের ব্যবস্থা করেছেন।
এবারের মতো আকস্মিক বন্যা নিকট অতীতে মানুষ দেখেনি; অথচ রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা কোন রকম বিদেশি সহায়তা ছাড়াই দক্ষ হাতে সে দুর্যোগ সামাল দিয়েছেন। ঠিক একইভাবে দেশে যখন মানুষ্যসৃষ্ট কোন দুর্যোগ দেখা যায়, শেখ হাসিনা তার নেতৃত্বের নৈপুণ্যতায় সে সংকট সমাধা করে ফেলেন। যেমন, দেশের গণতন্ত্র ও নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করতে এদেশে কিছু দল, গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তি বারবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সে চক্রের ষড়যন্ত্র সফল হতে দেননি। তিনি এদেশে গণতন্ত্র সঠিক রক্ষা করে রেখেছেন বলে দেশ উন্নয়নের পথে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ এক তথ্য উপস্থাপন করলে উন্নয়নের গতি-প্রকৃতি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে সবার কাছে- বৈশ্বিক সক্ষমতা সূচকে সাত ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচক বা গ্লোবাল কম্পিটিটিভ ইনডেক্সে (জিসিআই) ২০১৭-১৮ বছরে বাংলাদেশ ১৩৭টি দেশের মধ্যে ৯৯তম অবস্থান পেয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) বুধবার সারা বিশ্বে একযোগে এই সূচক প্রকাশ করেছে।
Advertisement
বলার অপেক্ষা রাখে না, এরূপ আপসহীনতা ও আস্থাশীলতার কারণেই বিশ্বের বুকে শান্তিকন্যা শেখ হাসিনা সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তার নেতৃত্ব আজ বিশ্বনেতাদের কৌতূহল এবং আগ্রহের বিষয়েও পরিণত হয়েছে। বিশ্বের নামি দামি সংবাদ মিডিয়াগুলোর একাধিক জরিপে ইতোমধ্যে বিশ্বনেতাদের তালিকায় শেখ হাসিনার নাম সামনের সারিতে স্থান করে নিয়েছে। সময়ের সাথে ক্রমাগত স্থান সামনে এগিয়ে আসছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে শেখ হাসিনা তার সততা, আত্মত্যাগ, দূরদর্শিতা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন– এটাই হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।
লেখক: কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সাবেক সংসদ সদস্য।
এইচআর/বিএ