বিশেষ প্রতিবেদন

বাংলাদেশে অবিশ্বাস বলেই মিয়ানমারে ভরসা গড়ছে ভারত

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার। কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ নিয়ে গবেষণা করছেন, লিখছেন রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়েও।

Advertisement

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। ‘রোহিঙ্গা সঙ্কট আন্তর্জাতিক ইস্যু’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধর্মীয় ও জাতিগত দ্বন্দ্ব থাকলেও ভারত, চীন ও রাশিয়ার আগ্রাসী নীতির কারণে এ সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে চলমান সঙ্কট আশু সমাধানও দেখছেন না এই বিশ্লেষক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। তিন পর্বের দ্বিতীয় পর্ব আজ প্রকাশিত হলো।

জাগো নিউজ : আরাকান অঞ্চল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে মার্শাল ল’ জারি হয়। ওই সময় থেকে কি আরাকানে বৌদ্ধদের প্রভাব বাড়তে থাকল?

Advertisement

সাখাওয়াত হোসেন : হ্যাঁ, ঠিক ওই সময়ই। সামরিক সরকারের চিন্তা থাকে মানুষের দুর্বল জায়গা পুঁজি করে শাসন করা। ধর্ম মানুষের তেমনই দুর্বল জায়গা। মিয়ানমারের বৌদ্ধদের সেনা সরকার মদদ দিয়ে আরাকানে প্রতিষ্ঠা করতে থাকল।

১৯৬২ সালে যখন ইউনিয়ন অব বার্মা রোধ করে ‘এক দেশ, এক নীতি’ গ্রহণ করা হলো, তখন কাচিন, চিন, কারেন রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনের জন্য যারা লড়াই করছিলেন, তারা আর্মি থেকে বের হয়ে গেলেন। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আরাকানের আরএসএসহ অন্য সংগঠনগুলোও।

১৯৭৮ সালে আরাকানের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে আঘাত হানা হয় রোহিঙ্গাদের ওপর। ওই বছরই অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

তখন বাংলাদেশের সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান মিয়ানমারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে চুক্তি করেন। এরপরও রোহিঙ্গাদের ওপর আঘাত থেমে থাকেনি। এরই মধ্যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হতে শুরু করলেন। বাংলাদেশের সীমানা, মানুষও ওই ফ্যাক্টরের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকল।

Advertisement

১৯৯১ সালে বার্মার ২১টি জায়গায় আন্দোলন চলছিল। আরাকানেও। ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর আরেকটি রাষ্ট্রীয় হামলা হয়। ওই সময় ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতেও তীব্র আন্দোলন দেখা দেয়।

১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব প্রদানের যখন নতুন করে রূপ দেয়া হয়, তখন রোহিঙ্গাদের বাদ দেয়া হয়। অথচ ১৯৬১ সালেও আরাকানের মংডু, বুথিডং, কাসিডং থেকে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়।

জাগো নিউজ : ২০১২ সালের দাঙ্গার প্রেক্ষাপট কি একই ধাঁচের ছিল?

সাখাওয়াত হোসেন : ওই দাঙ্গা বৈশ্বিক আগ্রাসনের ফলে হয়েছে বলে আমি মনে করি। চায়নার গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন করতেই ওই দাঙ্গার সৃষ্টি বলে মনে করা হয়। পাইপলাইন করতে আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গাদের সরানোর সিদ্ধান্ত নিল সরকার। রোহিঙ্গারা বাধা দিতেই বিপত্তি ঘটল। গুজব ছড়ানো হলো, চারজন রোহিঙ্গা মিলে একজন বৌদ্ধ তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এরপরই দাঙ্গা।

ওই দাঙ্গার পর অনেকেই বাংলাদেশে চলে আসেন এবং অনেককে মিয়ানমারের উত্তরে সিতওয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়।

চাইনিজরা সেখানে উন্নয়ন শুরু করল, তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান চালাতে থাকল, পাইপলাইন বসাতে থাকল এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার চেষ্টা চলল; পাশাপাশি রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদেরও চেষ্টা চলল।

এরপর তো অং সান সু চি ক্ষমতায় এলেন।

জাগো নিউজ : চায়না তো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিত। এখন তো সু চি ক্ষমতায়। মিয়ানমার অনেকটাই উন্মুক্ত। তবুও কেন...

সাখাওয়াত হোসেন : সু চি ক্ষমতায় আসার পর মিয়ানমার অনেকটাই উন্মুক্ত। চায়নার নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কমে যায়। কিন্তু মিয়ানমারের কারেন, সান, কাচিনসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে অস্থিরতার জন্য চায়না সমর্থন এবং অস্ত্র দিতে থাকল। সান রাজ্যের ওয়া নামক একটি জায়গায় মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলা হয়, ওয়ার কাছে চাইনিজ বর্ডার। ওয়া ইন্ডিপেনডেন্ট নামের একটি আর্মিও রয়েছে সানে।

১৪টি সংগঠনের সঙ্গে সমঝোতা করতে পারলেও মিয়ানমারে এখনও আটটি সংগঠন আন্দোলন করে যাচ্ছে এবং ভারি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করছে।

জাগো নিউজ : এমন লড়াই তো রোহিঙ্গারা করছে না?

সাখাওয়াত হোসেন : রোহিঙ্গাদের শক্তি কম। অস্ত্র নেই। একটি নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করে সেখানে অবস্থান করবে- এমন শক্তি কখনই ছিল না তাদের। রোহিঙ্গাদের সমর্থনে চায়না, ভারত এমনকি বাংলাদেশ কখনই ভূমিকা রাখেনি। তারা বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলনের চেষ্টা করছে।

জাগো নিউজ : বলছিলেন চায়নার আগ্রাসনের কথা...

সাখাওয়াত হোসেন : মিয়ানমার উন্মুক্ত হওয়ার পর আরাকানের ওই অঞ্চল খুবই গুরুত্ব পেতে থাকল চায়নার কাছে। চায়না ইতোমধ্যে গ্যাস ও পাইপলাইনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে, যার একটি চালান ২০১৭ সালে সৌদি আরবে গেছে। দুটি এনার্জি করিডোর তৈরি করে চায়না বিকল্প পথ করে রেখেছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব এড়ানো যায়।

আরাকানের সিতওয়েতে যে বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা তৈরি করা হয়েছে, সেখানে চীন-ই বিনিয়োগ করেছে। অনেক জটিল বিষয়। আর সব বিষয়ের প্রভাব পড়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর।

জাগো নিউজ : মিয়ানমারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ভারতও মরিয়া…

সাখাওয়াত হোসেন : কিছুদিন আগে ভারত মিয়ানমারের কালাদান প্রজেক্টে প্রায় ৫শ’ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে সহায়তা করেছে। উত্তর থেকে কালাদান নদী এসে সিতওয়েতে মিলেছে। ভারতের হলদিয়া পোর্ট থেকে মিয়ানমারের সিতওয়ে পোর্ট। সিতওয়ে পোর্ট থেকে কালাদান নদী হয়ে মিয়ানমারের উত্তরে প্রদেশ চিনের প্লেটওয়ায় অর্থাৎ ভারতের দক্ষিণ মিজোরামের কাছে একটি অভ্যন্তরীণ পোর্ট করা হচ্ছে। আর কালাদান নদীর ড্রেজিং করে দিচ্ছে ভারত।

বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারত ভৈরব-আখাউড়া-ত্রিপুরা হয়ে একটি ট্রানজিট তৈরি করেছে। এর বিকল্প পথ করছে কালাদান প্রজেক্টের মাধ্যমে।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশ তো ট্রানজিট দিয়েছে। এরপরও কেন বিকল্প পথ গুরুত্ব পাচ্ছে?

সাখাওয়াত হোসেন : বাংলাদেশে অবিশ্বাস বলেই মিয়ানমারে ভরসা গড়ছে ভারত। অনিরাপদজনিত শঙ্কা থেকেই ভারত এখানে বিকল্প পথ খুঁজছে। কোনো কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বে কোচবিহার করিডোর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পুরো সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

জাগো নিউজ : এমন শঙ্কা কি কাজ করে?

সাখাওয়াত হোসেন : ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর সীমান্তে ভারতের দখলে থাকা একটি জায়গা চায়না দাবি করে আসছে। ডোকলামের ওই পয়েন্ট নিয়ে ভারত-চীনের মধ্যকার বিরোধ তুঙ্গে। এমন আরেকটি পয়েন্ট ভুটানের কাছে। কখন কী ঘটে যায় সেই আশঙ্কা থেকেই ভারত মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে পথ খুঁজতে চাইছে।

এসব ভূ-রাজনৈতিক কারণেই আরাকানের গুরুত্ব বেড়ে গেছে।

জাগো নিউজ : ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু মিয়ানমারে যুগলযাত্রা...

সাখাওয়াত হোসেন : চায়নার সঙ্গে মিয়ানমার ভারসাম্যের সম্পর্ক রাখতে চাইছে। চায়নার নিয়ন্ত্রণ থেকে একেবারে বের হয়ে আসারও উপায় নেই। কারণ চায়না পরিকল্পিতভাবে মিয়ানমারের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোয় অস্থিরতা বাড়িয়ে রাখছে। এখনও অস্ত্র সরবরাহ হচ্ছে।

কিন্তু প্রচুর বিনিয়োগের কারণে মিয়ানমার চায়নাকে ছাড়তেও পারছে না। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে চীনের সেনাবাহিনীর ব্যাপক সম্পর্ক রয়েছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মিয়ানমারের কোকান রাজ্যে কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটে, যে হামলায় ৩২ জন সেনা অফিসার নিহত হন। বিদ্রোহী দমনে মিয়ানমার সে অঞ্চলে সর্বাধুনিক হেলিকপ্টার ব্যবহার করে। তার মানে মিয়ানমার একধরনের যুদ্ধের মধ্যেই আছে। এজন্য চায়নাকেই দায়ী করে আসছে মিয়ানমার। এরপরও বিনিয়োগের কারণে চায়নাকে পাশে রাখতে চাইছে মিয়ানমার

জাগো নিউজ : চায়নার এই দ্বৈতনীতি মিয়ানমারকে আসলে কী দেবে?

সাখাওয়াত হোসেন : আপতত উন্নয়ন করে দিচ্ছে। সু চি সরকারের উন্নয়ন দরকার। আর চাইলেও মিয়ানমারের ওই রাজ্যগুলো থেকে চায়নার নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে পারবে না দেশটি। এখানে শক্ত অবস্থান নিলে মিয়ানমারই ভেঙে যাবে। এ শঙ্কা থেকেই চায়নাকে ছাড় দেয়া।

জাগো নিউজ : একই নীতি কী ভারতের ক্ষেত্রেও?

সাখাওয়াত হোসেন : চায়নার নীতি আর ভারতের নীতির মধ্যে তফাৎ আছে। তবে ভারত কালাদান নদীর প্রজেক্ট নিরাপদ রাখার জন্য আরাকান অঞ্চল রোহিঙ্গামুক্ত চায়। কারণ রোহিঙ্গারা থাকলে তাদের বিশ্বাসে ঘাটতি থাকে।

এএসএস/এমএআর/আইআই