জাতীয়

সন্ত্রাসীর গুলিতে দেশে বাবা, আর বিদেশে নিহত হলেন ছেলে

পুলিশ সদস্য মো. রফিকুল ইসলাম হাওলাদার। দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন তিনি। ঠিক ১৪ বছর পর এবার বিদেশের মাটিতে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হলেন তারই ছেলে সেনা সদস্য মনোয়ার হোসেন হাওলাদার।

Advertisement

মনোয়ার হোসেনের পরিবার ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১৫ বছর আগে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন মনোয়ার হোসেন। আট বছর আগে বিয়ে করেন তিনি। মা, স্ত্রী ইভা, পাঁচ বছরের মেয়ে ইলমন ও দেড় বছরের মেয়ে তাসমীমকে বরিশাল নগরীর জিয়া সড়কের বাড়িতে রেখে গত জুন মাসে শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দিতে মালির উদ্দেশে রওনা দেন।

১০ মাসের জন্য বিদেশে যাওয়ার সময় স্ত্রী ও মা’কে বলেছিলেন, ১০ মাসের আগেই ফিরে আসব। মনোয়ার ঠিকই তার কথা রেখেছেন। ১০ মাসের আগেই তিনি দেশে ফিরে এসেছেন, তবে লাশ হয়ে।

মনোয়ারের ফিরে আসার সেই আনন্দ অপেক্ষা এখন পরিণত হয়েছে বিষাদে। স্ত্রী-সন্তানদের চোখে এখন শুধুই অশ্রু। দেড় বছরের শিশু অবুঝ তাসমীম এখনও জানে না ‘না ফেরার দেশে’ চলে যাওয়া তার বাবা আর কখনও-ই তাকে আদর করে কোলে নেবে না।

Advertisement

নিহত মনোয়ারের অপর ভাই মাস্টার্সে অধ্যয়নকালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। বৃদ্ধ মা রওশন আরার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছোট ছেলে রবিউল ইসলাম পুলিশের চাকরি পেয়ে বর্তমানে খুলনায় ট্রেনিংয়ে আছেন। তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন স্বামী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় বসবাস করেন।

বরিশাল সদর উপজেলার চন্দ্রমোহনে পারিবারিক কবরস্থানে মনোয়ারের লাশ দাফন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবারের সদস্যরা।

আফ্রিকার মালিতে গত শনিবার সন্ত্রাসীদের পুঁতে রাখা ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণে মনোয়ারসহ তিন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হন। এ সময় আহত হন আরও চারজন।

যেভাবে নিহত হলেন বাংলাদেশি তিন শান্তিরক্ষী

Advertisement

পশ্চিম আফ্রিকার সংঘাতময় দেশ মালি। ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে মালির ইতিহাস অস্থিরতায় পরিপূর্ণ।

দীর্ঘ সামরিক শাসন এবং গোষ্ঠিগত সংঘাতে বিপর্যস্ত দেশটিতে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা কাজ শুরু করেন ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে।

২০১২ সাল থেকে দেশটিতে সংঘাত বেড়ে যায়। সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখায় সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে শান্তিচুক্তি হলেও সেটি টেকসই হয়নি। এরপর মালি সরকারের অনুরোধে ২০১২ সালের শেষের দিকে জাতিসংঘ দেশটিতে বহুজাতিক শান্তিরক্ষী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

কিন্তু এরপরও সংঘাত থেমে থাকেনি। বিভিন্ন সময় শান্তিরক্ষীরা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। সে রকম একটি আক্রমণের ঘটনা ঘটে ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ওপর। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর বলছে, শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সময় গত ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষের ধারাবাহিকতায় ২৪ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব পালন শেষে ক্যাম্পে ফেরার সময় সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হন শান্তিরক্ষীরা। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে সন্ত্রাসীদের পুঁতে রাখা ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস বা আইইডি বিস্ফোরণে তিন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী নিহত এবং চারজন আহত হন।

নিহত শান্তিরক্ষীরা হলেন- সার্জেন্ট আলতাফ, ল্যান্স কর্পোরাল জাকিরুল, সৈনিক মনোয়ার। আহতরা হলেন- মেজর জাদিদ, পদাতিক (ঢাকা), কর্পোরাল মহিম, পদাতিক (নোয়াখালী), সৈনিক সবুজ, পদাতিক (নওগাঁ) এবং সৈনিক সরোয়ার, পদাতিক (যশোর)। আহতদের গাঁও শহরে উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানান্তর করা হয়েছে।

মালিতে কর্মরত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর সংখ্যা প্রায় ১৭০০। এর মধ্যে সেনা সদস্যের সংখ্যা প্রায় ১৩০০।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেবার পর থেকে ১৩৫ জন শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে পুলিশ বাহিনীর ২০ সদস্য এবং বাকি সবাই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য।

ভালো আছেন আহতরা

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান সোমবার রাতে জাগো নিউজকে বলেন, মালিতে আহত চার বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সেনা বর্তমানে ভালো আছেন। তাদের অবস্থা দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। আশা করছি, দ্রুত তারা সুস্থ হয়ে উঠবেন।

নিহত তিন সেনার মরদেহ দেশে আনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতিসংঘের কিছু ফরমালিটিস (নিয়ম-কানুন) আছে। সেগুলো সম্পন্ন করতে একটু সময় লাগবে। আশা করি দু-তিনদিনের মধ্যে তাদের মরদেহ বাংলাদেশে পৌঁছাবে।

এমএআর/এমএস