শহুরে রোমান্টিক ও রাশভারী তরুণের ভূমিকায় দারুণ মানালেও সব ধরনের চরিত্রে ছিল তার সরব বিচরণ। আশির দশকের রূপালি পর্দার অন্যতম স্টাইলিশ নায়ক তিনি। বলছি বাংলা চলচ্চিত্রেরের এক সময়ের ‘হার্টথ্রব’ নায়ক জাফর ইকবালের কথা।
Advertisement
সুদর্শন, অভিনয় দক্ষতা, পোশাকে স্মার্ট স্টাইলের উপস্থিতি ছিল অসাধারণ। এই কারণগুলোই তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। আর পর্দায় তার অভিনয় এবং বিশেষ পর্দায় তার স্মার্ট উপস্থাপন তরুণদের কাছে তাকে করেছিল সর্বাধিক প্রিয়।
শুধু নায়ক নয়, একজন গায়ক হিসেবেও নামডাক ছিল তার। জাফর ইকবাল জন্মেছিলেন ১৯৫০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে। বাড়িতে গান-বাজনার রেওয়াজ ছিল। তার বোন শাহানাজ রহমতুল্লাহ একজন সুপরিচিত কণ্ঠশিল্পী। বড় ভাই আনোয়ার পারভেজও নামকরা শিল্পী।
১৯৭১ সালের আগে চলচ্চিত্রে অভিষেক হলেও জাফর ইকবাল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ৮০’র দশকে। চলচ্চিত্রে তার আগমন ঘটে মুক্তিযুদ্ধের আগে আগে কবরীর বিপরীতে ‘আপন পর’ ছবিতে অভিনয় করে। সেটিই তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র। এরপর যুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন জাফর ইকবাল। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন।
Advertisement
‘সূর্যসংগ্রাম’ ও এর সিকুয়্যাল ‘সূর্যস্বাধীন’ চলচ্চিত্রে ববিতার বিপরীতে অভিনয় করেন। ১৯৭৫ সালের ‘মাস্তান’ ছবিটি তাকে সে প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের রাগী, রোমান্টিক, জীবন-যন্ত্রণায় পীড়িত কিংবা হতাশা থেকে বিপথগামী তরুণের চরিত্রে তিনি ছিলেন পরিচালকদের অন্যতম পছন্দ। ধীরে ধীরে সামাজিক প্রেমকাহিনী ‘মাস্তান’র নায়ক জাফর ইকবাল রোমান্টিক নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। ‘নয়নের আলো’ চলচ্চিত্রে এক গ্রামীন তরুণের চরিত্রেও দর্শক তাকে গ্রহণ করে দারুণভাবে।
ক্যারিয়ারে জাফর ইকবাল ১৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। যার বেশিরভাগই ছিল ব্যবসা সফল। ১৯৮৯ সালে জাফর ইকবাল অভিনীত ত্রিভূজ প্রেমের ছবি ‘অবুঝ হৃদয়’ দারুণ ব্যবসা সফল হয়। এ ছবিতে চম্পা ও ববিতা- দুই বোনের বিপরীতে তার অভিনয় দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। ববিতার সঙ্গে তার জুটি ছিল দর্শক নন্দিত। জাফর ইকবালের সঙ্গে ববিতা জুটি বেঁধে প্রায় ৩০টি ছবিতে অভিনয় করেন। সে সময় জাফর ইকবাল এবং ববিতা জুটি মানেই ছিল হিট ছবির আভাস। এই জুটির বাস্তব জীবনে প্রেম চলছে বলেও গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ায় হতাশ হয়েই জাফর ইকবাল অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান বলে জোর গুঞ্জন উঠেছিল।
জাফর ইকবাল সবমিলিয়ে প্রায় ১৫০ ছবির নায়ক। তার অভিনীত ‘ভাই বন্ধু’, ‘চোরের বউ’, ‘অবদান’, ‘সাধারণ মেয়ে’, ‘একই অঙ্গে এত রূপ’, ‘ফকির মজনুশাহ’, ‘দিনের পর দিন’, ‘বেদ্বীন’, ‘অংশীদার’, ‘মেঘবিজলী বাদল’, ‘সাত রাজার ধন’, ‘আশীর্বাদ’, ‘অপমান’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘নয়নের আলো’, ‘গৃহলক্ষ্মী’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘প্রেমিক’, ‘নবাব’, ‘প্রতিরোধ’, ‘ফুলের মালা’, ‘সিআইডি’, ‘মর্যাদা’ ,‘সন্ধি’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রগুলো ছিলো সুপারহিট।
এই অভিনেতা গায়ক হিসেবেও ছিলেন সমান জনপ্রিয়। স্কুল, ক্লাবের কোনো অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলেই গিটার বাজিয়ে গান গাইতেন। জাফর ইকবাল ১৯৬৬ সালে প্রথম একটি ব্যান্ড দল গড়ে তোলেন এবং তার প্রথম সিনেমায় গাওয়া গান ছিল ‘পিচ ঢালা পথ’। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ফকির মজনু শাহ’ ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি রুনা লায়লার সঙ্গে ‘প্রেমের আগুনে জ্বলে পুড়ে’ গানটিতে কণ্ঠ দেন। ‘বদনাম’ ছবিতে জাফর ইকবালের কণ্ঠে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’ গানটি একসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
Advertisement
চলচ্চিত্রের বাইরে তার গাওয়া গানগুলোর মধ্যে ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’, ‘যেভাবে বাঁচি, বেঁচে তো আছি’, ‘এক হৃদয়হীনার কাছে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। জাফর ইকবাল আমৃত্যু একজন গায়ক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে আনন্দবোধ করেছেন।
আশির দশকের শুরুতে তার ক্যারিয়ার নানা কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি ছিলেন বেশ খামখেয়ালী, আবেগপ্রবণ এবং দারুণ অভিমানী। অনিয়মিত জীবনযাপন ও অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে তার হৃদযন্ত্র ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাফর ইকবালের ক্যারিয়ার যখন মধ্যগগনে তখন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। ১৯৯১ সালে ২৭ এপ্রিল মাত্র ৪১ বছর বয়সেই থেমে যায় ঢাকাই চলচ্চিত্রের রুপকথার রাজপুত্রের গল্প।
চলে গেছেন কতোকাল পেরিয়ে গেল। তবু এই নায়কের নাম এলেই তার সমসাময়িক প্রযোজক, পরিচালক, নায়িকা, সহশিল্পীরা ও দর্শক মনে মনে আঁকেন দুর্দান্ত রোমান্টিক এক যুবকের মুখ। কানে ভাসে রোমান্টিক কোনো সংলাপ, গান। সময় বয়ে গেছে। কিন্তু বয়স বাড়েনি আমাদের জাফর ইকবাল। মৃত্যুকে জয় করে আজও তিনি রোমান্টিক।
এনই/এলএ